‘চার অন্যায়ের শিকার কোটা আন্দোলনকারীরা’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামা ছাত্ররা হামলাসহ চারটি অন্যায়ের শিকার বলে শিক্ষকদের একটি প্রতিবাদী সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে। হামলার শিকারদের পাশে না দাঁড়ানোয় শিক্ষকদেরও সমালোচনা করা হয়েছে এই কর্মসূচি থেকে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে রবিবার ৪০ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাবেশ ও পদযাত্রা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা এই হামলার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দের’ ব্যানারে রবিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন। সেখানে তারা ছাত্রদের ওপর হামলার স্থান পরিদর্শন শেষে পদযাত্রা করে যান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

এতে ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ শিক্ষক অংশ নেন। পরে সেখানে হয় সমাবেশ। বক্তারা বলেন, যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আর সেই অধিকার যদি কেউ হনন করে তবে তারা মুক্তিযোদ্ধা চেতনা বিরোধী।

সমাবেশে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিরাজ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায় ইউল্যাবের ভিজিটিং অধ্যাপক আসফার হোসেন প্রমুখ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো যৌক্তিক আন্দোলনে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অবিশ্বাস্যও বটে। কারণ পাকিস্তান ও ব্রিটিশ শাসনামলে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘কোটা সংস্কারের মত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা চার ধরনের অন্যায়ের স্বীকার হয়েছে।’

‘তাদেরকে হাতুড়িপেটা করা হয়েছে, মেয়েদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, গুরুতর আহত করা হয়েছে, এইটা প্রথম অন্যায়। আর দ্বিতীয় অন্যায় হল তাদেরকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তৃতীয় অন্যায় হল আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। চতুর্থ অন্যায় তাদের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ দেয়া হয়েছে।’

‘প্রতিবাদ করার অধিকার হল সবচেয়ে মৌলিক একটি মানবাধিকার। এই প্রতিবাদ অধিকারের চর্চা ছিল বলেই আমরা এই দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি। আর এই অধিকারের বিরোধীরা করে তারা মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী, দেশবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ও সংবিধানবিরোধী।’

তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ‘সবচেয়ে ভাল ছাত্ররাই ঢাবির শিক্ষক হন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিপদে সকলে এগিয়ে আসতে পারেন না। কারণ যারা ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক তারাই সব সময় শিক্ষার্থী বিরোধী হয়। তারা ভুলে যান, শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ানো সকল শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষক অস্তিত্বহীন।’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করে এই শিক্ষক বলেন, ‘মস্তিস্কহীন প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ আমাদের পরিচালনা করেছে। যার ফলে বারবার এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।’

আজফার হোসেন বলেন, ‘কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারেন না। কারণ তারা সরকারের চামচা। আরেকদল আছে যারা আসতে চায়। কিন্তু ভয় পায়। সব মিলিয়ে দেশ একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।’

মানববন্ধনে চার দফা দাবি তুলে ধরেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন। দাবিগুলো হলো: কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর হামলাকারীদের বিচার, আন্দোলনকারীদের নামে ‘মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহার, হামলায় আহতদের চিকিৎসা সেবা প্রদান, নারী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নকারীদের বিচার ও দ্রুত কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দেয়া।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার ওপর গত ৩০ জুলাই হামলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে। এই হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচিতে দুই দিন পর হামলা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা হয়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে হাতুড়িপেটায় এক ছাত্রের পায়ের হাড় ভেঙে ফেলার ঘটনায় তোলপাড় চলছে এক সপ্তাহ ধরে।

গত ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের ঘোষণার আলোকে প্রজ্ঞাপন দাবি করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে ২৭ জুলাই কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদ খাঁন এক ভিডিও বার্তায় তাদের সঙ্গে ‘প্রতারণা করা হয়েছে’ যাবতীয় বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেন।

‘রক্ত গরম হয়ে যাওয়া’ রাশেদ সেদিন আরও কঠোর আন্দোলনের সিদ্ধান্তের কথা জানান।

‘মনে হচ্ছে তার বাপের দেশ। সে একাই দেশের মালিক। ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা বলবে, আর আমরা কোনো কথা বলতে পারব না’-রাশেদের এমন বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে অভিযোগ করে ক্ষুব্ধ হয় ছাত্রলীগ এবং এরপরেই হামলা হয় কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর।

ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গিয়ে ছাত্রদের পিটুনির পাশাপাশি ওই সপ্তাহে ছাত্রদের পিটুনির প্রতিবাদে ‘উদ্বিগ্ন অভিভাবক এবং নাগরিকদের’ সমাবেশেও বাধা দেয় পুলিশ।

আবার হামলার শিকার নুরুল ইসলাম নুরকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে জোর করে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহীতেও তরিকুল ইসলামের চিকিৎসা শেষ না করেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।