চার বছরের সাফল্যের চেয়ে এক বছরের চ্যালেঞ্জই বড়

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের চার বছর পূর্তি শুক্রবার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিজয়ী দলটি ১২ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। দু’বারে মন্ত্রিসভা রদবদল ও নতুন অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছে সরকার। চার বছরের এ দীর্ঘ যাত্রায় সরকার প্রধান শেখ হাসিনার প্রাপ্তির ঝুলিতে দুটি উপাধি ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সরকারের উন্নয়ন বেশ দৃশ্যমান হয়েছে।

তবে শেষ বছরেই নানা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প সমাপ্তি, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া এ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সুশাসন, গণতন্ত্রায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ, কৃষি, ধর্মীয় স্বাধীনতার মত ৫টি অগ্রাধিকারসহ ২৬টি গুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামের এই ইশতেহারে দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, নগরায়ণ, পরিকল্পতি উন্নয়ন, ১০ হাজার থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়টি উঠে আসে।

এর মধ্যে নানা কর্মসূচিতে বেশ ভালো করলেও সরকারের এই চতুর্থ বছরে ঘূণিঝড় মোরা, পাহাড় ধস, বন্যা, বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়ে যাওয়া, চাল ও পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কুমিল্লা ও রংপুর সিটিতে নির্বাচনী মহাবিপর্যয়, শীর্ষ চার নেতার মৃত্যুর শোক, রোহিঙ্গা সংকট, প্রশ্নফাঁস ও ঘুষ নিয়ে সর্বশেষ শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য বারবার বিপাকে ফেলেছে সরকারকে।

তবে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ ও সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ডের পর বিশ্বের তৃতীয় সৎ নেতা ও ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাব ছিল এ বছরে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার অর্জন।

এছাড়া বিভিন্ন খাতে সরকারের সাফল্য ছিল চোখে পড়ার মত। তবে সরকারের এ চার বছরের সাফল্যের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চলমান প্রকল্পগুলোর সমাপ্তি, রোহিঙ্গা সংকট নিরসন ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া।

সরকারের উন্নয়নের চিত্র-

নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার :
দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং প্রত্যন্ত চরাঞ্চলসহ সারাদেশে প্রায় ৪৫ লাখ সোলার হোমসিস্টেম বসানো হয়েছে। মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদন করা হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে। পাবনার রূপপুরে ২০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ৪৯৭ কিলোমিটার বিতরণ লাইন ও ৫৪৩ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি ঋণ :
খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ। ৮ বছরে প্রায় ৪০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বর্গাচাষীদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্পসুদে বিনা জামানতে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা।

সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি :
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে চলতি বছর ১৪২টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ কর্মসূচি বাবদ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ বছরে ২ লাখ ২৯ হাজার ১৬৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

বয়স্ক ভাতা ও দুস্থ নারী ভাতা :
৩১ লাখ ৫০ হাজার বয়স্ক ভাতাভোগীকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা প্রদান। ১১ লাখ ৫০ হাজার বিধবা স্বামী নিগৃহীতা, দুস্থ মহিলাকে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা প্রদান। ভিজিডি কর্মসূচির উপকারভোগী দুস্থ মহিলা সংখ্যা ১০ লাখ। সারাদেশে হতদরিদ্র ১০ লাখ মহিলাকে মাসিক ৩০ কেজি চাল প্রদান করা হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫ লক্ষে উন্নীত করা; কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে মোট ১ লাখ ৮০ হাজার ৩০০ জন দরিদ্র মা’কে ভাতা প্রদান।

নারী উদ্যোক্তা ভাতা :
বাজেটে নারী শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ। নারী শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বিসিক শিল্পনগরীতে ১০ শতাংশ প্লট বাধ্যতামূলক সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। এছাড়া হিজড়া এবং বেদে সম্প্রদায়ের জন্য ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়েছে। চা শ্রমিকদের জন্য অনুদান ১০ কোটি থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ কোটি করা হয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প :
এ পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং গৃহায়ণ কর্মসূচিসহ অন্যান্য প্রকল্পের মাধ্যমে আরো ২ লাখ ৮০ হাজার পরিবার পুনর্বাসন করা হবে। প্রায় ৫৫ লাখ একর কৃষি জমি ১ দশমিক ২০ লাখ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
১০ টাকা মূল্যে চাল। ২০১৬ এর সেপ্টেম্বর মাস থেকে ৫০ লাখ পরিবারকে প্রতি কেজি ১০ টাকা মূল্যে চাল সরবরাহ করা হয়েছে।

বাড়ছে সামাজিক সুরক্ষার আওতা :
বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৩১ লাখ ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩৫ লক্ষে উন্নীত করা। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ লাখ ৬৫ হাজারে উন্নীত করা। অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ লাখ ২৫ হাজারে এবং মাসিক ভাতার পরিমাণ ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকায় উন্নীত করা।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তির উপকারভোগীর সংখ্যা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ৫ হাজার করে মোট ১০ হাজার বৃদ্ধি করা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা খাতে বরাদ্দ ২ কোটি ৩৫ লাখ বাড়িয়ে ১১ কোটি ৩৫ লক্ষে উন্নীত করা। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বিশেষ/বয়স্ক ভাতার খাতে বরাদ্দ ৬ কোটি ৩২ লাখ বাড়িয়ে ২৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা। ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির বরাদ্দ ২০ কোটি বাড়িয়ে ৫০ কোটি টাকায় উন্নীত করা। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং খাদ্য-দ্রব্যাদির পরিবর্তে জনপ্রতি এককালীন নগদ ৫ হাজার টাকা করে প্রদান। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিদ্যমান মাথাপিছু সম্মানী ভাতার পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা হারে বছরে দু’টি উৎসব ভাতা প্রদান। দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকাল ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়িয়ে ৬ লক্ষে উন্নীত করা। কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়েদের মাতৃত্বকাল ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা ২০ হাজার বাড়িয়ে ২ লক্ষে উন্নীত করা।

রফতানি আয় :
২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৩৪ দশমিক ৮৪৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

প্রবৃদ্ধির হার :
২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।

শিক্ষা :
সারাদেশে গত ৯ বছরে মোট ৩০০ কোটি বই বিতরণ। মায়ের হাসি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ম শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থীদের মায়েদের কাছে মোবাইল ফোনে উপবৃত্তির কাছে পাঠানো হয়েছে। ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়েছে। একইসঙ্গে এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারি করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনকরা হয়েছে। বিদ্যালয়বিহীন ১ হাজার ১২৫টি গ্রামে নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ৩৬৫টি কলেজ সরকারি করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গিয়ে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ।

২০০৯ সালে থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। একই সময়ে বেসরকারি খাতে ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪২টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৬টি।

কারিগরি শিক্ষা :
কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণে ১ম পর্যায়ে ১০০টি উপজেলায় ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। কিশোরগঞ্জ, মাগুরা, মৌলভীবাজার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১টি করে মোট ৪টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগীয় সদরে ৪টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগে ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য :
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন। দরিদ্র্য মানুষকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ৬৪টি জেলা হাসপাতাল ও ৪২১টি উপজেলা হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ৮ বছরে ১২ হাজার ৭২৮ জন সহকারি সার্জন এবং ১১৮জন ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখন মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ৭ মাস। মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ১.৮ জনে এবং শিশু মৃত্যু ২৯ জনে হ্রাস পেয়েছে। গত ৮ বছরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ২৪টি সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার শয্যা বাড়ানো হয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে মোট সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ১৪টি, যা বর্তমানে ৩৬ টিতে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৬৯টি। সরকারি-বেসরকারি মিলে ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা ২৮টি। অটিস্টিক শিশুদের সুরক্ষায় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

যোগাযোগ :
এ সরকারের ৮ বছরে ৩৬৮.৬২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ৪৮টি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকায় হাতিরঝিল প্রকল্প, কুড়িল-বিশ্বরোড বহুমুখী উড়াল সেতু, মিরপুর-বিমানবন্দর জিল্লুর রহমান উড়াল সেতু, বনানী ওভারপাস, মেয়র হানিফ উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রায় ৯ কিমি দীর্ঘ বহুল প্রতীক্ষিত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার উদ্বোধন। মেট্রোরেল নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন চালু হয়েছে। নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা সড়ক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক ৪-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। চন্দ্রা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম ৮-লেনের মহাসড়ক চালু করা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় কাচপুর, ২য় মেঘনা এবং ২য় গোমতী সেতু নির্মাণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। ঢাকার যানজট নিরসনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ বাস্তবায়ন হবে।

রেল :
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৯৩ কিলোমিটার বিদ্যমান রেলপথ সংস্কার করা হয়েছে। ৪৫ দশমিক ২১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৭টি নতুন রেলসেতু, ১০টি নতুন স্টেশন, ২২টি রেলসেতু পুনঃনির্মাণ, ৬টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ প্রথম দফায় ৬০টি বন্ধ স্টেশন চালু। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার চারদিকে সার্কুলার ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। সার্কুলার ট্রেন চালানো গেলে যানজট আর থাকবে না। ইলেকট্রিক ট্রেন ও পাতাল ট্রেনের সম্ভ্যবতা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

নৌ যোগাযোগ :
যাত্রী পরিবহনের জন্য ৪৫টি নৌযান নির্মাণ ও চালু করেছে। দুটি যাত্রীবাহী জাহাজ ও চারটি সি-ট্রাক জাতীয় নৌ পরিবহনে সংযুক্ত হয়েছে। নৌ-পথের নাব্যতা বৃদ্ধি করতে ১৪টি ড্রেজার কেনা হয়েছে। আরো ১৭টি ড্রেজার ক্রয় প্রক্রিয়াধীন আছে। ৪টি অভ্যন্তরীণ নদী বন্দর স্থাপন করা হয়েছে। কাঁচপুর, সন্দ্বীপ ও কুমিরায় নৌ-যানের ল্যান্ডিং সুবিধা দেওয়া হয়েছে। নৌ পরিবহনের ক্ষেত্রে বিআইডব্লিউটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ২৭৬ ঘন লাখ মিটার ড্রেজিং সম্পন্ন করেছে। বিআইডব্লিউটিসি যাত্রীবাহী ৩৮টি জাহাজ, ৫০টি ফেরি, ৪০টি কার্গো জাহাজ ও ৫৩টি সহায়ক জাহাজের সমন্বয়ে তিনটি ইউনিটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় রুটে নিরাপদ যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে।

বিমান ও পর্যটন :
বাংলাদেশ বিমানের জন্য ৬টি সুপরিসর উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৮ সাল নাগাদ আরো ৪টি উড়োজাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ সড়ক উদ্বোধন হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ :
৫ হাজার ২৭৫ টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮২০০ ই-পোস্ট অফিস থেকে জনগণ ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজে দরকার এমন অনেক মোবাইল অ্যাপস চালু। লার্নিং আর্নিং এর মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থান। দেশে মোবাইল সিম গ্রাহক ১৩ কোটি ৯৩ লাখ। ইন্টারনেট গ্রাহক ৭ কোটি ৭১ লাখ ৪২ হাজারে পৌঁছে গেছে। চলতি বছরের মধ্যেই মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে কাজ চলছে। ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’। ডিজিটাল দ্বীপ মহেশখালী উদ্বোধন। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি শেখ রাসেল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চল :
শিল্পায়ন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। এতে এক কোটির বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে।

তথ্য ও সম্প্রচার :
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা। বেসরকারিখাতে ৪৬টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন।

বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে সরকার থেকে ৫ কোটি টাকার সিডমানি, ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার অনুদান এবং ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছে। সাংবাদিকদের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন :
বর্তমান সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছে। কমিশন এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ :
স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালীকরণে কয়েক ধাপে উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরেই সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়ন :
নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদে নারীর অবস্থানের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান সংসদে স্পিকার ছাড়াও সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধী দলের নেতাও নারী, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ ২ পূর্ণমন্ত্রী এবং ৩ প্রতিমন্ত্রী, সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২১ নারী সরাসরি নির্বাচিত এবং সংরক্ষিত ৫০টি আসনে নারী এমপি রয়েছেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ঘোষণা ও বাস্তবায়ন। মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ কার্যকর। মাতৃসূত্রে নাগরিক হওয়ার বিধানসহ নাগরিক আইন সংশোধন। পুলিশ বাহিনীতে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে মহিলা পুলিশ ইউনিটের অংশগ্রহণ। নারীদের জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন গঠন; প্রথমবারের মতো বিজিবিতে নারী সদস্য নিয়োগ। আপিল বিভাগে সর্বপ্রথম নারী বিচারপতি নিয়োগ। বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো নারী ভিসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি একজন নারী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে ৬০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষিত। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের জন্য গেজেটেড পদে ১০ ভাগ, নন-গেজেটেড পদে ১৫ শতাংশ কোটা। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক নিয়োগে নারীদের অগ্রাধিকার। ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও সাড়ে ১২ হাজার নার্স নিয়োগ। ডিপ্লোমা নার্সদের পদমর্যাদা ও বেতনস্কেল ২য় শ্রেণিতে উন্নীত। বাজেটে নারী শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ। নারী শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য বিসিক শিল্পনগরীতে ১০ শতাংশ প্লট বাধ্যতামূলক সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। গার্মেন্টেসে কর্মরত নারীদের সুবিধায় আশুলিয়া ও সাভারে ১৬ তলাবিশিষ্ট হোস্টেল নির্মাণ। নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণে ৪০ টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন।

যুব উন্নয়ন :
যুবসমাজের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে দেশের ৬৪টি জেলা ও ৪৯৬টি উপজেলায় বেকার যুবদের উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রশিক্ষণোত্তর আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাবলম্বীকরণ, যুবঋণ প্রদান, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদি কর্মসূচি চালু রয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে ১৮,৮৬,২৮৪ জন যুবক ও যুবমহিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে এবং ৪,৯৪,৩০০ জন আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় ডিসেম্বর ২০১৭ মাস পর্যন্ত মোট ১,১২,৬৮৫ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ১,১০,৩৫১ জনের অস্থায়ী কর্মসংসস্থানের ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে। যুব সমাজের জন্য ১১টি নতুন প্রকল্প চালু করেছে এসব পূর্ণ বাস্তবায়িত হলে সারা দেশে ১৪,৩২,১০৪ জন বেকার যুবক ও যুবমহিলা উপকৃত হবে এবং ৩১ হাজার বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপিত হবে। ১১টি জেলায় আবাসিক যুব প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের কাজ দ্রুতই শেষ হবে এবং ২৯টি যুব প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাধ্যমে যুব সংগঠনসমূহের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘যুব সংগঠন (নিবন্ধন এবং পরিচালনা) আইন, ২০১৫’ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।

বেতন-ভাতা বৃদ্ধি :
সামরিক-অসামরিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও ব্যাপক পদোন্নতির সুযোগ করে দিয়েছি। জাতির পিতা প্রণীত ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে আর্মড ফোর্সেস গোল- ২০৩০ নির্ধারণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। পুলিশ, র‍্যাব, আনসার, বিজিবি ও সশস্ত্রবাহিনীর ঝুঁকিভাতা দেওয়া হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়েছে।

ক্রীড়াঙ্গন, শিশু উন্নয়ন, আইন বিচার ও সংসদ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নয়নে সরকারের নানা পদক্ষেপ লক্ষ্যণীয়।