চুয়াডাঙ্গায় বিয়ের কবল থেকে বেরিয়ে জিপিএ-৫ পেল বিপ্লবী বর্ষা

বাল্য বিয়ের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই বর্ষা এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

বিপ্লবী বর্ষার বন্ধ হয়েই যাচ্ছিল পড়ালেখা। গরীব মায়ের সংসারে পেটভরে খাওয়ায় যেখানে কষ্টকর সেখানে মেয়েকে পড়ালেখা করানো একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বর্ষার মা বিউটি খাতুনের। তিনি স্থানীয় একটি মুড়ি কারখানায় চাকরী করেন। ফলে আর্থিক অভাবের কারণে গত বছর দশম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় বর্ষার বাল্য বিয়ে ঠিক করেন মা বিউটি খাতুন। এমন ঘটনা বুঝতে পেরে সচেতনতা ও বিপ্লবীর পরিচয় দিয়ে বর্ষা নিজেই চলে আসে চুয়াডাঙ্গার সদর থানায়। করেন একটি লিখিত আবেদনও। সেখানে সে উল্লেখ করে, ‘আর্থিক দুরবস্থার কারণে বিয়ে দেয়া সব সমস্যার সমাধান নয়, বরং বাল্যবিয়ের কারণে আমাদের দেশে হাজারো কিশোরী মেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। একপর্যায়ে অপমৃত্যুর শিকারও হয় অনেক কিশোরী গৃহবধূ।’

থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনকে বর্ষা বলেছিল, ‘বাল্যবিয়ে নয়, আমি পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আপনারা সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করলে কেউই আমার উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ঠেকাতে পারবে না। পরে ওসি মোহাম্মদ মহসিন মানবিক দিক চিন্তা করে মেধাবী ছাত্রীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে বর্ষার পরিবারকে ডেকে বাল্য বিয়ের আয়োজন বন্ধ করে দেন।

পরে ঘটনা জানাজানি হলে পড়ালেখার খরচ হিসেবে প্রতিমাসে ১ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার। বর্তমানে তিনি আছে। সেসময় তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ মহসিন স্কুলে যাওয়ার আসার খরচ বহনে সহযোগিতা করতেন। সেসময় সংবর্ধনাও দেয়া হয় জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে।

সোমবার (২৮ নবেম্বর) এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে জিপিএ-৫ পাওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় এক অন্যরকম সারা ফেলেছে। শুধু তাই নয় তার এ বিপ্লবী মানসিকতার পরিচয়ে অন্যদেরকেও সাহসিকতার সৃষ্টি করেছে।

গরীব মা বিউটি খাতুনের পরিবারে নতুন করে আলো জ্বালিয়েছে বর্ষা। পরিক্রমায় ভবিষ্যতের উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে পখা চলায় হবে বর্ষার জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু বর্ষায় নয় দেশের প্রতিটি মেধাবি-ছাত্রছাত্রীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সুদৃষ্টি থাকলে দেশ ও জাতি উভয়ই উন্নত হবে।

শ্রাবন্তী আক্তার বর্ষা চুয়াডাঙ্গা শহরের ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। ওই বিদ্যালয় থেকে মোট ১৯ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে।

মা-বাবার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায় মায়ের সঙ্গে সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের দৌলতদিয়াড়ে নানাবাড়িতে থাকে বর্ষা। তার বাবা ও বড় ভাই থাকেন যশোরে। বর্ষার মা বিউটি খাতুন একটি মুড়ির কারখানায় কাজ করেন।

মেয়ের সাফল্যে বর্ষার মা বিউটি খাতুন আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমার যত কষ্টই হোক, মেয়েকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে যা যা করার সবই করা হবে।’
বর্ষার এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শ্রাবন্তীর সহপাঠীরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘সে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে। মূলত আর্থিক সমস্যার কারণে বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। আবার কখনো সামাজিক কারণেও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে থাকে। যদিও আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে সাংবিধানিক ও সামাজিকভাবে একটা অপরাধ। এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও এটা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে শ্রাবন্তীর এই সাফল্য ও বিপ্লবী মনোবল অনেক মেয়ের সামনে বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

সবা বাধা পেরিয়ে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির পেছনে শিক্ষক আর পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বর্ষা বলেন, ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল ইসলাম ও পৌর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ তাকে বিনা পয়সায় পড়াতেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরাও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। পরিবারের সদস্যরা তাদের ভুল বুঝেছেন। এখন তারা সব সময় তাকে উৎসাহ দেন।

বর্ষা ভবিষ্যতে বিসিএস ক্যাডার হতে চায়। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় এ ভূমিকা রাখতে চায়। সে বলে, নিজে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলেও বিভিন্ন প্রতিক‚লতার কারণে অনেক মেয়ে সেটা পারছে না। পরিবার ও স্বজনদের সিদ্ধান্তের বিপরীতে নিজের ইচ্ছার কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না। এতে অকালে অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে।

তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা সদর এবং বর্তমান ঢাকা উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, বর্ষাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তাকে এখনো ভুলিনি। বাল্যবিয়ে বন্ধে থানায় আসার জন্য অনেকে সমালোচনা করেছিল। এটা হলো সেই সমালোচকদের জবাব। এ রকম বর্ষাদের পাশে থাকলে তারা জাতির একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেতে পারবে। আজকে আপনাদের মাধ্যমে সবাই জানবে মেয়েরা সাহসী হলে সব সম্ভব। বর্ষার জন্য শুভকামনা। আমি তার পাশে থাকব।