জামাই-মেয়ের উৎসাহে জামায়াত ছেড়ে জঙ্গি নেতা সাজ্জাদ!

জামায়াতের ওয়ার্ড পর্যায়ের শীর্ষ নেতা থেকে জামাই-মেয়ের উৎসাহে সাজ্জাদ আলী হয়ে উঠলেন জঙ্গি নেতা। জড়িয়ে ফেললেন পরিবারের সকলকে। তবে জেএমবির শীর্ষ নেতা বাংলা ভাইয়ের আমলেই জঙ্গি নেতা হবার চেষ্টা করেছিলেন চাচাতো ভাই মিনারুলের মাধ্যমে। কিন্ত মনিরুলের জেল আর বাংলা ভাইয়ের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে যাওয়ায় জঙ্গি কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই মাস আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের মাছমারা হাবাসপুর এলাকার বেনীপুর গ্রামের শেষপ্রান্তের ফসলের জমিতে বাড়ি করেছিলেন জঙ্গি নেতা সাজ্জাদ। এর আগে প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি পাশের গ্রাম মাছমারায় শ্বশুরবাড়ির পাশেই থাকতেন। ওই বাড়িতে নিয়মিত ইসলামী বৈঠক বসাতেন সাজ্জাদের স্ত্রী বেলী আক্তার। গ্রামের নারীদের ডেকে ইসলামের কথা শোনাতেন তিনি। সাজ্জাদ আলীর ছেলে সোয়েব আলী ও আল-আমিন আগে দাড়ি কামাতেন না। তাঁরা বলতেন, তাঁরা কখনো গালে ব্লেড ঠেকাননি, ঠেকাবেনও না। তবে কয়েক মাস আগে তাঁরা দাড়ি কেটে ফেলেছিলেন। কারো সঙ্গে কখনো ঘনিষ্ঠভাবেও মিশতেন না।

সাজ্জাদ মূলত এলাকায় ‘মিষ্ট’ নামে পরিচিত। তবে গ্রামের মানুষ তাঁকে জামায়াত নেতা হিসেবেই চিনতেন। কিন্ত জেএমবির সদস্য ছিলেন বা সাংগঠনিক তৎপরতা চালানোর বিষয়টি কেউ বুঝতে পারেনি। সাধারণ মানুষের মতো তিনি সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে কাপড় বিক্রি করতেন। তাঁর স্ত্রী বেলী আক্তার বাড়িতে দর্জির কাজ করতেন। কোনো নারী কাপড় তৈরীর জন্য গেলে ইসলামের তালিম দিতেন বেলী।

তার দুই মেয়ে সুমাইয়া ও কারিমার মুখ কখনো দিনের আলোতে দেখেননি প্রতিবেশীরা। তাঁরা প্রতিবেশী কারো বাড়িতেও যেতেন না।

সাজ্জাদের পরিবারের এই তিন নারী দিনে দুবার বাড়ির বাইরে পানি আনতে বের হতেন। একবার রাত ১০টার পর। আরেকবার ভোরের আলো ফোটার আগে। কোথাও গেলে তাঁরা বোরকা পরে বের হতেন। হাতের কবজি আর চোখ ছাড়া তাঁদের কিছুই দেখা যেত না তাদের।

সাজ্জাদের শ্বশুর লুৎফর রহমান জানান, আগে তার জামাতা সাজ্জাদ ও মেয়ে বেলী আক্তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করত। কিন্তু ৫-৬ বছর থেকে তারা পাল্টে যায়। তারা গ্রামের কোনো মানুষের সঙ্গেই মিশত না। এমনকি শ্বশুর বাড়ির সঙ্গেও চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল সাজ্জাদ। মুখে দাড়ি থাকলেও সাজ্জাদ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন না। বেনীপুরের মাঠে যে জমিতে সাজ্জাদ বাড়ি করেছিলেন, সেটির চারপাশেই ধান চাষ করা হয়। দু’মাস আগে বাড়িটি তৈরির সময়ও চারপাশে বোরো ধান ছিল। এমন নির্জন স্থানে বাড়ি করার কারণ হিসেবে লুৎফর রহমান মনে করেন, ‘একঘরে’ থাকতেই সাজ্জাদ সেখানে বাড়ি করেছিলেন।

তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে সাজ্জাদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর সে বেনীপুর গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গেই ছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর শ্বশুরের গ্রামে একটি খাস জমিতে বাড়ি করেন। কিন্তু ওই জায়গাটি ছিল নিরিবিলি। সেখানে একা থাকতে পারবেন না বলে তার নিজের কিছু এবং আরও কিছু জায়গা কিনে মাছমারা গ্রামে সাজ্জাদকে তার বাড়ির পাশে বাড়ি করে দেন। এরপর ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু বছর ছয়েক আগে থেকে পাল্টে যেতে থাকে সাজ্জাদের পরিবার। দর্জির কাজের সময় বাড়িতে কোনো নারী গেলে তাকে ইসলামের কথা শোনাতে শুরু করে মেয়ে বেলী আক্তার। মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলেদের সঙ্গেও বাড়িতে আনাগোনা বাড়তে থাকে অচেনা যুবকদের। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ শুনতে পান, সাজ্জাদ তার মায়ের গ্রামের শেষপ্রান্তে ধানী জমিতে বাড়ি করেছে। কিন্তু সে বাড়িতে তার যাওয়া হয়নি।

গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, মনিরুল ছিলেন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) কর্মী। বাংলা ভাইয়ের হাত ধরে ২০০৫ সালের দিকে সে জেএমবিতে যোগ দেন। ওই সময়ই মনিরুলের হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেন সাজ্জাদ আলী। যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই মনিরুল চট্টগ্রামে অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ১০ বছরের কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। ফলে সাজ্জাদ সাংগঠনিকভাবে আর বেশিদূর এগোতে পারেননি। এই সময়কালিন তিনি নিজ এলাকাতে জামায়াত ইসলামীর কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এদিকে বছর দুয়েক আগে কারাভোগ শেষে মনিরুল গ্রামে ফেরেন। সেই সাথে মেয়ে সুমাইয়ার স্বামী জামায় জহুরুল জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। ফলে পুরাতন জেএমবি ও নব্য জেএমবি নাম নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে। জেএমবি সদস্যদের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ। পেশায় একজন কাপড়ের ফেরিওয়ালা হলেও এর আড়ালেই সে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন।

সূত্রটি জানায়, গত বছরের ৩১ অক্টোবর গোদাগাড়ীর চরাঞ্চলের দিয়াড় মানিকচক গ্রামে জহুরুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এরপর তাকে গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সে সময় সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। পরে কড়া নিরাপত্তায় রাখার জন্য তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন জহুরুলই তার শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে তথ্য দেয়। এরপর থেকেই পরিবারটিকে নজরদারির ভেতরে রাখে পুলিশ।

মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আজম তৌহিদ সাংবাদিকদের জানান, সাজ্জাদের মেয়ে সুমাইয়ার স্বামী জহুরুল জঙ্গি সংগঠন জেএমবির কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত চারমাস ধরে পড়ে কারাগারে আছেন। জহুরুলের বাড়ি গোদাগাড়ীর দিয়াড় মানিকচকে। এক সময় এলাকার মানুষ তাকে ‘পল্লী চিকিৎসক’ হিসেবে চিনলেও পরে তিনি জেএমবিতে জড়ান।

তিনি বলেন, সাজ্জাদ আগে মাছমারা তার শশুর বাড়িতে থাকতেন। সেখান থেকে তার নিজ গ্রামে ওই মাঠের মধ্যে সে ঘরে করে সেখানে বসবাস শুরু করে। দুই-তিন বছর আগে সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিল। তারা দুইজনে জামায়াতের পক্ষে প্রচার চালাত। বিশেষ করে সাজ্জাদের স্ত্রী বেলী জামায়াতের নারী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। গ্রামে গ্রামে গিয়ে মহিলাদের জামায়াতের পক্ষে সংঘটিত করার কাজ করতে সে বলে জানান তিনি।

গোদাগাড়ী থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সি বলেন, সাজ্জাদের পুরো পরিবার আশরাফুলের মাধ্যমেই সুইসাইড স্কোয়াডে যোগ দিতে পারে। তাছাড়াও তার জামায় জহুরুল একজন জঙ্গি সদস্য। ফলে পর্যায়ক্রমে সবাই জঙ্গি সদস্য হয়ে যান। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কোন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, গত ১০ মে বুধবার রাত থেকে বেনীপুর গ্রামে সাজ্জাদ আলীর বাড়ির পাশে অবস্থান নেয় পুলিশ। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে সাজ্জাদ আলীর পরিবারের সদস্যদের হামলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মী আবদুল মতিন নিহত হন। আহত হন আরো দুই পুলিশ সদস্য। এরপর সাজ্জাদ আলী (৫০), তাঁর স্ত্রী বেলী আক্তার (৪৫), তাঁদের ছেলে আল-আমিন ওরফে হামজা (২০), মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) এবং বহিরাগত জঙ্গি আশরাফুল ইসলাম (২৩) পুলিশের অপরাশেন সান ডেভিল অভিযান চলাকালে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ও গুলিতে নিহত হন।