ঢাবি শিক্ষার্থী হত্যা: স্ত্রীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার তবে হত্যা অস্বীকার স্বামীর

স্ত্রীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলার স্বামী ইফতেখার আবেদীন শাওন। তবে স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকার কথা কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছেন না তিনি। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

মেঘলার স্বামীকে তৃতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এলমার মৃত্যুরহস্য জানার চেষ্টা চালাচ্ছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হয়, নির্যাতনের কারণেই এলমার মৃত্যু হয়েছে। স্ত্রীকে হত্যার কথা ইফতেখার স্বীকার না করলেও তার বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হবে বলে জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া জানান, এটি একটি স্পর্শকাতর ঘটনা। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইফতেখারকে তৃতীয় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, অতি দ্রুত আদালতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

গত ১৪ ডিসেম্বর বনানীতে শ্বশুরবাড়ি থেকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এলমা চৌধুরীকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আনা হয়। পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওইদিন চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। পরে পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্নের কথা উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া পরিবার ও সহপাঠীরা আঘাতের চিহ্ন দেখে তাকে হত্যা করার অভিযোগ করেছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গছে এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে এলমার স্বামী ইফতেখার আবেদীন শাওন, তার শ্বশুর আমিন ও শাশুড়ি শিরিন আমিনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনার একদিন পরই পুলিশ এলমার স্বামী ইফতেখারকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ইফতেখারকে আগে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রথমে তিনি নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছিলেন। তবে পরে জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের কথা স্বীকার করেন। ইফতেখারের দাবি, গত ১৩ ডিসেম্বর রাতে তাদের মধ্যে বিতণ্ডা হওয়ার একপর্যায়ে এলমাকে মারধর করেন তিনি। তার দাবি, স্ত্রী মরে যেতে পারে এমন নির্যাতন করেননি তিনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইফতেখার কানাডাপ্রবাসী, তিনি চতুর প্রকৃতির মানুষ। সামান্য মারধর করার কথা জানালেও হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করছেন না। আদালতেও তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে চান না। ইফতেখারের বাবা-মাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের ধরা গেলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এলমার স্বামী ইফতেখার অনেকটা সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি। তার পরিবারের সদস্যরা কিছুটা মারমুখী ও রক্ষণশীল। তারা এলমাকে ‘ডমিনেট’ করে রাখতে চাইত। এলমা প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো।

এলমার পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীদের দাবি, ঘটনার একসপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো ইফতেখারের বাবা-মাকে ধরা হয়নি। দ্রুত ইফতেখারের বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করে হত্যাকাণ্ডের কারণ ও জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি আনার দাবি জানান তারা।

বুধবার (২২ ডিসেম্বর) এলমার বাবা আদালতে ইফতেখারের রিমান্ড শুনানির সময় সাংবাদিকদের জানান, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার মেয়েকে পৈশাচিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ঘটনার দিন তারা ফোন করে এলমা অসুস্থ জানিয়ে হাসপাতালে যেতে বলে। কিন্তু তিনি হাসপাতালে গিয়ে মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পান। এ সময় মেয়ের শরীরে অসংখ্য মারধরের চিহ্ন ছিল।

বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) পুরান ঢাকার জজকোর্টের সামনে এলমার পরিবারের সদস্য, স্বজন ও সহপাঠীরা মানববন্ধন করেন।

সহপাঠী ও স্বজনরা জানান, মাস ছয়েক আগে কানাডাপ্রবাসী ইফতেখার চৌধুরী শাওনের সঙ্গে বিয়ে হয় এলমার। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষা ও আড্ডায় মেয়েটির সরব উপস্থিতি থাকলেও বিয়ের পর তার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমনকি তাকে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষকরা জোর করে তাকে মাস্টার্সে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু এলমাকে পরীক্ষাতেও বসতে দেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন।