দেখা মেলে না পদ্ম মধু, শালুক আর ঢ্যাপের খই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে চলনবিল

দেশের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক জলসম্পদে ভরপুর চলনবিলের নাম শুনলেই দেহমনে জাগে অন্যরকম শিহরণ। ষড়ঋতুর এই দেশে- প্রাকৃতিক ঐশ্যর্যের লীলাভূমি এই চলনবিলকে সাজতে দেখা যায় একেক ঋতুতে একেক রূপে। বিলটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বর্ষাকাল।

এই ঋতুতে সাগরের মতো বিশাল জলরাশি বুকে নিয়ে ভয়ংকর সৌন্ধর্য নির্মাণ করে এ বিল। শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের কারুকাজ। হেমন্তে আপন নৈপুন্যে সৃষ্টি করে মাথা নুয়ানো সোনালি ধানের শৈল্পিক বাহার আর সোঁদা মাটির গন্ধে পাগল করে চারদিক। শীতে প্রান্ত ছোঁয়া কাঁচা হলুদ রংয়ের থইথই উচ্ছ্বাস আর দীগন্ত জোড়া সবুজের থরথর কম্পন। গ্রীষ্মে চলন বিল আপন পৌরুষে দেখা দেয় তেজী ও রুক্ষ রূপে। দেশের বৃহত্তম এই বিলের এত যে রূপ এত যে ঐশ্বর্য তার সবকিছুই যেন আজ অতীত। স্মৃতি মন্থন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলাই যেন এই বিরাট চরাচরের মানুষের নিয়তি!

দখল-দূষণের কবলে পড়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে দেশের বৃহত্তম চলনবিলের নদ-নদী। বহুবিধ কারণে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বিলের অধিকাংশ খাল। ভূ-উপরিস্থ পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে নীচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও। ফলে খুব নিরবে বিলুপ্ত হতে বসেছে বিলের জীববৈচিত্র্য। সেইসাথে বিরাট এই অঞ্চলের কৃষকের বুকে টনটনে ব্যাথা জাগিয়ে ব্যাহত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কৃষি আবাদ। এছাড়া আরও বহু কারণে দেশের সর্ববৃহৎ এই প্রাকৃতিক জলসম্পদে ভরপুর চলনবিল দিনদিন হারিয়ে ফেলছে তার চিরচেনা রূপ আর গৌরবময় ঐতিহ্য।

যে চলনবিলে আর্শ্বিাদের মত ফোটে ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ নানা প্রজাতির শাপলা ফুল ও গুল্মলতা। চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল ও বেগুণী শাপলা ফুল মাথা উঁচু করে টেনে ধরে কোমল হৃদয়। বর্ষা মৌসুমে বিলে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় এই সমস্ত আর্শ্বিাদের মত পদ্ম। এদিকে আবহমান কাল থেকেই শাপলা ও এর মূলে হৃদপিন্ডের মত বেড়ে ওঠা শালুক মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত ছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত পদ্ম মধু, শালুক, ঢ্যাপের খই ও খইয়ের মোয়া। নিরবে নিভৃতে বুকের গহীনে ব্যাথা জাগিয়ে সবকিছু যেন গ্রাস করে চলছে অতীত। একসময় চলনবিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষেরা বিল থেকে পদ্ম মধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রকারের শাপলা। ফলে ওইসব অভাবী মানুষের অনেকেই বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে আবার অনেকেই পেশা বদলেছে। ‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুরের একাংশ, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯৬৭ সালে এম এ হামিদ ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গঠনকালে চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৩১ দশমিক ০ কিলোমিটার। এছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈঘর্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার। জানা যায়, কয়েক বছর আগেও চলনবিলের ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃগরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, বড়বিলা, বালোয়াবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, তাড়াশের বড়বিল, বিদ্যাধর ঠাকরুণেরবিল, নলুয়াকান্দিবিল, ঘরগ্রামবিল, বেরলবিল, কচিয়ারবিল, কাশিয়ারবিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, রউল শেওলা বিল, পাতিয়াবিল, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিল, পাওয়া যেত নানা প্রজাতির প্রচুর শাপলা ফুল। এছাড়া চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িতে এখনো নানা রঙের শাপলার অপরুপ দৃশ্য দেখা যায়। শুকনো মওসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যায়। ফলে চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা গুল্মলতা ও জলজ প্রাণি। জানা যায়, সাদা বর্ণের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল এক আশ্চর্যের নাম এবং খুবই প্রিয়।

বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বিল বাওড় জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আবাদে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে শাপলা ফুল। এখন খাল-বিল-জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। আগে অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরে চাষ করতেন লাল শাপলা। এখন পুকুরে বিদেশি কার্প জাতীয় মাছ চাষ হওয়ায় বেগুণী ও লাল শাপলা বিলুপ্তির পথে। আগে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত ঢ্যাপের খই মোয়া। এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না পদ্ম মধু ও সুস্বাদু ঢ্যাপের খইয়ের মোয়া। পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলোগ্রাম, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাইমেটার ৮.৪, ক্রড আমিষ ১৬.৮, ক্রড ফ্যাট ২.৮, ক্রড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ।’ অতীতকাল থেকেই শাপলার ফল দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খই ভাজা হয়। যেটি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে ঢ্যাপের খই নামে পরিচিত। শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যায় তখন অভাবী মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করে। সিদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। শাপলা চুলকানি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। ডায়াবেটিক, বুক জ্বালা, লিভার, ইউরিনারি সমস্যা ও নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে লাল শাপলা খুবই উপকারী। কৃষিবিদগণের মতে, শাপলা ৩ প্রকারের হয়ে থাকে। সাদা বেগুণী ও লাল রঙের। এরমধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ঔষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ সবজি। সাধারন শাক-সবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমান আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল বিল জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে দেশে বাণিজ্যিকভাবে শাপলার চাষ হয় না বলেও জানিয়েছেন কৃষিবিদরা।