দেবী দুর্গাকে বরণে মন্দিরে মন্দিরে জোর প্রস্তুতি

আকাশ-বাতাসে কেবলই আগমনীর সুর। দ্বারপ্রান্তে কড়া নাড়ছে বাঙালির তেরো পার্বণের অন্যতম শারদীয় দুর্গোৎসব। শরতের মেঘের ভেলায় যেন লালচে আবীর পরে শিউলি ফুলের আবেশ মেখে মা দুর্গা আসছেন ঘরে।

আগামী ৮ অক্টোবর মহালয়ায় দেবীপক্ষের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গোৎসবের ক্ষণ গণনা। ওইদিন ভোরে রেডিও-টেলিভিশনে বেজে উঠবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠে মাতৃবন্দনা—‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীমছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে, আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন। আজ চিচ্ছক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রীবিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।’

শাস্ত্র মতে মহালয়া অর্থ হচ্ছে মহান আলোয় দুর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গাকে আবাহন করা। শঙ্খের ধ্বনি আর চন্ডীপাঠের মধ্যদিয়ে ধরিত্রীতে আবাহন জানানো হয় ত্রিনয়নাকে। শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ এই মহালয়া। এদিন ভোরে চন্ডী পাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে মর্ত্যলোকে।

মহালয়ার পর আগামী ১৪ অক্টোবর (২৭ আশ্বিন) পঞ্চমী তিথিতে সায়ংকালে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। দশপ্রহরিণী দুর্গার অসুরদলনী তেজ ও বিভিন্ন আয়ুধের দ্বারা জগৎসংসারের যাবতীয় ক্লেদ ও গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলার প্রার্থনা ধ্বনিত হবে মানবমনে।

১৫ অক্টোবর (২৮ আশ্বিন) সায়ংকালে দেবীর বোধন ও ষষ্ঠীবিহীত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৬ অক্টোবর (২৯ আশ্বিন) মহাসপ্তমী, ১৭ অক্টোবর (৩০ আশ্বিন) মহাষ্টমী, ১৮ অক্টোবর (৩১ আশ্বিন) মহানবমী এবং ১৯ অক্টোবর (১ কার্তিক) বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।

বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে চড়ে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন। ফল-ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে অর্থাৎ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে ভক্তদের পাঁচদিনের বন্দনা শেষে বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী স্বর্গলোকে বিদায় নেবেন দোলায় করে। ফল- মড়কং ভবেৎ অর্থাৎ পৃথিবীতে মড়ক-খরা, মহামারি, যুদ্ধ, ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ বাড়বে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে এবার সারা দেশে ৩০ হাজারেরও বেশি পূজা মণ্ডপে দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। আর রাজধানী ঢাকায় ২৩০টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা হবে।

রাজধানীর প্রধান পূজা মণ্ডপ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরো মন্দির ধুয়েমুছে রঙ করে ঝকঝকে-তকতকে করে তোলা হয়েছে। মন্দিরের সামনের মাঠজুড়ে প্যান্ডেল স্থাপন ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজ চলছে। ইলেকট্রিশিয়ানরা আলোকসজ্জার কাজও এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছেন।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, দেবীকে বরণ করে নিতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সাজসজ্জা চলছে, প্রতিমা তৈরির কাজও প্রায় শেষ। আর পূজা আনুসাঙ্গিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পূজা কমিটির সবাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে মণ্ডপকেন্দ্রিক পূজার ব্যস্ততা ততই বাড়ছে।

প্রতিবারের মতো এ বছরও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমা গড়ছেন মানিকগঞ্জের প্রতিমাশিল্পী নারায়ণ চন্দ্র পাল।

তিনি পরিবর্তন ডটকমকে জানান, প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ, এখন রংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। যতেটা সম্ভব সুনিপুণভাবে দেবীকে সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি।

সরেজমিনে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, সূত্রাপুর, শাঁখারী বাজার, তাঁতীবাজার, রমনা কালী মন্দির ও জয়কালী মন্দিরসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, এরই মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে।

প্রতিটি মণ্ডপের প্রতিমা শিল্পীরাই প্রতিমায় মাটি লাগানোর কাজ প্রায় শেষ করেছেন। এখন তুলির আঁচড়ে প্রতিমার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে ভীষণ ব্যস্ত কারিগররা। আরেকটু নিপুণ করে দেবীকে সাজাতে উৎসাহেরও কমতি নেই তাদের মধ্যে। শুরু হয়েছে চোখ ধাঁধানো পূজামণ্ডপের মঞ্চ তৈরি ও নানা পরিকল্পনার কাজও। মণ্ডপ পরিচ্ছন্ন করার কাজও চলছে। মন্দির প্রাঙ্গণকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে মন্দিরগুলোতেও চলছে ঘষামাজা ও রঙের কাজ।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত বলেন, দুর্গাপূজার খুব বেশি দিন বাকি নেই। তাই শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি আমরা। প্রতিবারের মতো এবারো উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে দুর্গোৎসব উদযাপিত হবে। সার্বিক নিরাপত্তার এরইমধ্যে একাধিকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। পূজায় নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তাই নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। যতটুকু নিরাপত্তা দেয়ার দরকার, সরকার তাই দিচ্ছে।

অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, এবার ঢাকা মহানগরীতে ২৩০টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। গুরুত্বানুযায়ী এসব পূজা মণ্ডপকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।

তিনি বলেন, প্রত্যেক পূজামণ্ডপে ইন ও আউটের জন্য আলাদা গেইটের ব্যবস্থা করা হবে। সাদা পোশাকে ও ইউনিফর্মে পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। মণ্ডপে প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে ও ম্যানুয়ালি তল্লাশি করে সকলকে প্রবেশ করানো হবে।

মণ্ডপের ভেতরে ও বাইরে জেনারেটরসহ পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা হবে। থাকবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। মণ্ডপগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসিটিভি-আর্চওয়ে স্থাপন করা হবে। পুরুষের পাশাপাশি নারী স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন করা হবে। এসবি, ‍পুলিশ ও র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড দিয়ে অনুষ্ঠানস্থল সুইপিং করা হবে। বিসর্জনের দিনে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা হবে বলেও জানান ঢাকার পুলিশ কমিশনার।