ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাগেরহাটের শরণখোলার একমাত্র প্রত্মতাত্বিক নিদর্শন

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের নানা রকমের স্থাপত্যকলা। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অধিক জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন হলো বিভিন্ন অ লের জমিদার বাড়িসমূহ।

বিশেষ করে দেশভাগের সময়ে জমিদারদের ফেলে যাওয়া এ সকল বাড়ি এবং তাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রের সাথে মিশে আছে সাধারণ মানুষের দ্বারা সৃষ্ট এবং মুখে মুখে প্রচলিত ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী। এ সকল দৃষ্টিনন্দন নিদর্শনের উপর ভর করে গড়ে ওঠা পৌরাণিক কাহিনীসমূহের মাধ্যমে এখনও আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। বলছিলাম বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের সিংবাড়ি গ্রামে অবস্থিত “সিংবাড়ি মোহিনী কুটির”-এর কথা।

বাড়ির প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল আম বাগান। আম গাছের গোঁড়া চারিদিক পাকা শান বাঁধানো উঁচু স্থল। সামনের অংশ জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর। এর সাথেই সঙ্গ দিচ্ছে মনোরম সুবিশাল দীঘি। দীঘির ঘাটের সঙ্গে আছে পাকা শান বাধানো হেলান দিয়ে বসার জায়গা। বাড়ির চতুর্দিকে রয়েছে প্রসস্ত সীমানা প্রাচীর। দীঘির পাড়ের তিনদিক জুড়ে দাড়িয়ে আছে অসংখ্য তালগাছ আর নানা প্রজাতির ফলের গাছ।

অত্র অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস ঘেটে যতদূর জানা যায়, বৃটিশ শাসনের মধ্য ভাগে জমিদার শশী কুমার সিং গ্রামটির গোড়াপত্তন করেন। কালক্রমে তার নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় “সিংবাড়ি”। পরবর্তীকালে এই “সিংবাড়ি” আশেপাশের অ লে জমিদার বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। সিংবাড়ি গ্রামের এই জমিদার বাড়িতে যে স্থাপনা রয়েছে তা সকলের কাছে মোহীনি কুটির নামেই পরিচিত।

ইতিহাসের তথ্য অনুসারে জানা যায়, শশী কুমার সিং ১৮৫৭ সালে বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বাড়িটির কাজ জমিদার শশী কুমার সিং শুরু করলেও শেষ অবধি কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। পরবর্তী সময়ে তার বংশধর পুত্র মহাদেব সিং প্রাসাদটি সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করেন। মহাদেব সিং তার পরিবার নিয়ে এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তার দুই পুত্র কানাই চন্দ্র সিং ও হিরু চন্দ্র সিং ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে জমিদারি দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

তাঁর সময়ে এলাকার মানুষের সুপেয় পানির জন্য একটি দীঘি খনন করেন। সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা এবং প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিবছর পৌষ মাসের শেষ ভাগে প্রজাদের উপস্থিতিতে পুণ্যাহ উৎসবের আয়োজন করেন। জনশ্রæতি আছে, বার্ষিক খাজনা আদায় উৎসবের সময়ে প্রজাদের মনোরঞ্জনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। তিনি এলাকার জন-নিরাপত্তার স্বার্থে বিশেষ করে ডাকাতের হাত থেকে প্রজাদেরকে নিরাপদ রাখার জন্য এলাকায় চৌকির ব্যবস্থা করেন।

এর পাশাপাশি জনসাধারণের শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে একটি পাঠাগার স্থাপন করেন। যদিও জনশ্রæতি আছে, বর্ণবৈষম্যের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, কায়স্থদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এছাড়াও নানা ধরনের শোষণ আর নিপীড়নের কাহিনি এখনও স্থানীয় জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত আছে।
সিংবাড়ির মূল ভবনটি চৌকোনা ১৮টি খিলানবিশিষ্ট পিলারের ওপর নির্মিত।

মূল ভবনের সামনের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে আরো কিছু স্থাপনার অবশিষ্টাংশ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনও বর্তমান আছে। অন্দরমহলের জন্য ছিলো ভবনের পিছনের দিকে শান-বাঁধানো ঘাটসহ আরেকটি সুবিশাল দীঘি। ভবনের সম্মুখে রয়েছে মনজুড়ানো সুবিশালা দীঘি। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর কানাই চন্দ্র সিং ও হিরু চন্দ্র সিং দুই ভাই তাদের আত্বীয় স্বজন নিয়ে এখান থেকে পানশি নৌকাযোগে এ দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান।

এরপর পরিত্যক্ত সিংবাড়ি পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তখন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা বেহাত হয়ে যায়। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, সিংবাড়ির মধ্যে দুটি সিন্দুকসহ জমিদারদের ব্যবহার্য অনেক প্রকার তৈজস ছিল যা সাধারণ মানুষের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে লুট হয়ে যায়। এসকল বিষয়ে কোনো প্রকার তথ্য একাধিকবার অনুসন্ধান করেও খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

বর্তমানে ২০০ বছরের অধিক পুরানো এই পুরাকীর্তির দীর্ঘ ঐতিহ্য নিয়ে অযতœ-অবহেলার চিহ্ন বুকে নিয়ে অদ্যাবধি দাঁড়িয়ে আছে। যখন জমিদারি বর্তমান ছিলো তখন আশপাশের জনসাধারণ এই বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সাহসটুকু পেতো না। আজ সেই জমিদারের জমিদারিও নেই, দাপটও নেই। বরং বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই স্থাপত্যকলাও অযত্ম-অবহেলার দরুন এখন বিলীনের পথে।

বর্তমানে মূল বাড়ি (মোহিনী কুটির) সংস্কার করে ধানসাগর ইউনিয়ন ভুমি অফিস (তহশিল অফিস) হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় দুইশত বছরের পুরানো বীম, লোহার গরাদ, ভারী লোহার পাল্লা সময়ের ব্যবধানে অযতœ আর অবহেলায়, যথাযথ সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূল কাঠামো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো অচিরেই মাথায় উপরে দুর্বিসহ বোঝা হিসেবে জেঁকে বসার সমূহ সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও মূল ভবনসংলগ্ন নতুন ভূমি অফিস ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ভবনটি সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এলাকার এক শ্রেণির অসাধু চক্রের যোগসাজসে এর ইট, চুন, সুরকির নিপুণ কারুকাজ সম্বলিত ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ এবং অবশিষ্ট মূল্যবান সামগ্রী পাচার হয়ে যাচ্ছে। ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তরা জানান দিয়ে যায় এর পুরানো জৌলুস। তারই মাঝে কালের স্বাক্ষী হিসেবে আজও দাড়িয়ে আছে শুধু সামনের মূল ভবনের ফটকসহ কিয়দাংশ।

অযত্নে আর অবহেলার স্বাক্ষর দৃশ্যমান আছে এর চৌহদ্দীকে ঘিরে বেড়ে ওঠা বুনো লতা, গুল্ম আর আগাছাসকল। এক শ্রেণিল অসাধু চক্র ভূমিদস্যুরূপে অধিকাংশ জমি নামে-বেনামে অবৈধ দখলসত্ত ভোগ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী, সমাজপতি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও এই দায় সহজে এড়াতে পারেন না।

শুধুমাত্র এ বাংলার দক্ষিণা ল বলেই নয়, সমগ্র বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ব দক্ষিণের প্রান্তিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত এই শরণখোলা নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এতদস্বত্তেও শরণখোলার একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন, জমিদারদের ফেলে যাওয়া “মোহিনী কুটির” আজও ভ্রমণ পিপাসু বহু মানুষের পদচারনায় মুখরিত।

বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীদের কাছে ঐতিহাসিক নিদর্শনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু এবং আকর্ষণীয় স্থান সিংবাড়ির এই “মোহিনী কুটির”। নবপ্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে আজন্ম কৌতুহলের উৎস এবং এর ইতিহাস অনুসন্ধান তাদের মননশীলতার পঠন-পাঠনে আরও আগ্রহী করে তোলে।

লোক ও সংস্কৃতি গবেষক ড. আলীম আল রাজী বলেন, “‘সিংবাড়ি শরণখোলা অ লের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতিকে ধারন করে। আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করে নিজেদেরকে সম্মৃদ্ধ করতে পারি।

এজন্য “মোহিনী কুটির” সংস্কার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। “মোহিনী কুটির” সংলগ্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের যে আধুনিক ভবন গড়ে তোলা হয়েছে, তার ফলে অত্র অ লের একমাত্র পুরাকীর্তির নিদর্শন সিংবাড়িস্থ “মোহিনী কুটির”-এর সংরক্ষণ এবং সংস্কার অনেকটাই হুমকীর মুখে।

অত্র অঞ্চলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক এবং প্রশাসন যদি এই পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে অচিরেই হয়তো এর অবশিষ্ট চিহ্নটুকু হারিয়ে যেতে পারে।”

এ অবস্থায়, বিষয়টি প্রত্নতত্ত বিভাগের আশুদৃষ্টি গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এ বাড়িটি সরকারীভাবে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন হিসেবে অধিভুক্ত হলেই হয়তো এ অঞ্চলের জমিদার অধিবাসীদের জীবনধারার সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্বলিত একমাত্র নিদর্শন সংরক্ষণের ছোঁয়া পেতে পারে।

শরণখোলার এই সিংবাড়ি বা মোহিনীকুঠির দেখতে চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের সিংবাড়ি গ্রাম থেকে।