নাসিরনগর তাণ্ডব : নভেম্বরেই ৮ মামলার পুলিশি প্রতিবেদন

ব্রাহ্মণাবড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের চালানো তাণ্ডবের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। গেল বছরের এই দিনে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীরা উপজেলা সদরের অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া ৮ মামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীসহ গ্রেফতার হন ১২৪ জন। অবশ্য এদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন জামিনে কারামুক্ত।

তবে এক বছরেও আদালতে কোনো মামলারই প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশ। যদিও নাসিরনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাফর জানিয়েছেন, আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম দিকেই আদালতে সব মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও মামলার বাদী অঞ্জন দেব জানান, এক বছরেও মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় আমরা বিচার নিয়ে শঙ্কিত। দিন যত বাড়ছে আমাদের মনে শঙ্কাও তত বাড়ছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি অবিলম্বে যেন হামলায় জড়িত সকল আসামিকে বিচারের আওতায় আনা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর পবিত্র কাবা শরীফকে অবমাননা করে নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। এ ঘটনায় ২৯ অক্টোবর রসরাজকে আটক করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে নাসিরনগর থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এর পরই রসরাজের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো নাসিরনগর উপজেলা। পরদিন (৩০ অক্টোবর) মাইকিং করে সমাবেশ ডাকে দুটি ইসলামি সংগঠন। সমাবেশ শেষ হওয়ার পরপরই দুষ্কৃতকারীরা নাসিরনগর উপজেলা সদরের অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘর-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এরপর ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর ভোরে দুষ্কৃতকারীরা আবারও উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়েরর অন্তত ৬টি ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন ‘মূল হোতা’ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিসহ হামলার সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র দেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীসহ ১২৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলার বেশিরভাগ আসামি জামিনে কারামুক্ত হলেও ইউপি চেয়ারম্যান আঁখি এখনো কারান্তরীণ।

এছাড়া পুলিশের করা আইসিটি আইনের মামলায় আড়াই মাস কারাভোগের পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি জামিনে কারামুক্ত হন রসরাজ। পরবর্তী পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত আদালত রসরাজের জামিন মঞ্জুর করেন।

তবে রসরাজের ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার সেই ছবিটি কে পোস্ট করেছিল সেটি এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। যদিও পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে রসরাজ নিজেই ছবি পোস্ট করার কথা স্বীকার করেছিলেন বলে পুলিশের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়।

এদিকে হামলার এক বছর পর নাসিরনগরের চিত্র এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সেই সম্প্রীতির বন্ধন এখনো অটুট রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ভাঙচুরের শিকার মন্দিরগুলোতে এখন পূর্বের মতোই চলে পূজা অর্চনা। এবছরও মহা ধুমধামে নাসিরনগর উপজেলায় ১৩২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তবে হামলার ঘটনায় এখনো পর্যন্ত জড়িতদের বিচার শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন জানান, হামলার এক বছরেও জড়িতদের বিচার শুরু না হওয়া খুবই দুঃখজনক। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নাসিরনগর হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত আসতে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাসিরনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাফর বলেন, মামলাগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো অপরাধী যেন বাদ না পড়ে সেজন্যই আমাদের তদন্তে সময় লাগছে। তবে তদন্ত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করছি নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই আদালতে সব মামলার প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।