নিয়মিত নামাজ-রোজা করেন হিন্দু পরিবারটি

মাস দেড়েক আগে জ্যাঠামশাই মারা যাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ন্যাড়া হয়েছিলেন তিনি। সবে ছো ছোট চুল উঁকি দিচ্ছে। বড়সড় একটা রুমাল মাথায় বেঁধে মসজিদের ছাদটায় রোজাদারদের কাতারে ইফতারে বসলেন পার্থ। চল্লিশের এ যুবককে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না বন্ধুরা। মজা করে ডাকে, ‘মহম্মদ’ পার্থসারথি বসু! পার্থর তাতে বয়ে গেছে। দিনভর উপবাস শেষে আল্লাহকে ইমাম সাহেবের ধন্যবাদ জ্ঞাপন মিটতে, মোবাইলে নিষ্ঠাভরে টাইম মিলিয়ে খেজুরটা-কলাটা মুখে দিয়ে পিত্তরক্ষা করবেন।

বারাসত ডাকবাংলোর মোড় থেকে বড়জোর মিনিট দশেকের পথ। আশপাশে এক ঘর মুসলিমেরও বাস নেই এ মহল্লায়। কয়েক কিলোমিটার দূরে মধ্যমগ্রামের কোঁড়া, চন্দনপুর, কাটুরিয়া বা মছপুল থেকে আসেন রোজাদারের দল।

বারাসত-হৃদয়পুর রুটের অটোচালক আবু হোসেন মণ্ডল, সবজি বিক্রেতা আর্শাব আলি বা ঝকঝকে কলেজপড়ুয়া আজ্জু ওরফে শেখ আজহার উদ্দিনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, পাড়ার ডাক্তার মনোতোষ মিস্ত্রি বা রেলের অফিসার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

মসজিদের পাশে চলতে ফিরতে কপালে হাত ঠেকান অমুসলিমরা। কিংবা আদ্যিকালের বাদামগাছটার বাঁধানো বেদিতে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যান। ইফতারের আগে রাস্তার কল থেকে পানি ভরে দেওয়াতেও হাত লাগান কেউ কেউ। পাশেই আম-লিচুর মস্ত বাগান!

কিছুদিন হলো, সেখানে আবার ঠাকুর গড়ছেন পটুয়া নিশি পাল। পড়ে থাকা কাঠামোয় খড় লেপে আর কিছুদিন বাদেই শুরু হবে দুর্গা গড়ার কাজ। নিত্যকার জুম্মার জমায়েত, মসজিদের ছাদের ইফতার, রমজানের তারাবির নামাজ বা কোরআন পাঠে তাতে কখনো সমস্যা হয়নি।

বারাসতে পশ্চিম ইছাপুর নবপল্লির এ মসজিদটাই ধ্যানজ্ঞান বোসবাড়ির ছেলের। এ তল্লাটে ২০-২৫ বিঘা জমি জুড়ে বোসেদের বিষয়-আশয়। আজকের বুড়ো কর্তা দীপক বসু কালীপূজায় বাড়িতে উপস করেন। কিন্তু এ ৬৭ বছরেও রোজ সকাল-বিকেল মসজিদে হাজির হওয়া চাই।

সকাল ৭টায় নিজের হাতে মসজিদের মেঝে ঝাড়পোঁছ করলে, তবেই শান্তি। এ বয়সে নিজে রোজা রাখতে পারেন না। কিন্তু তার ছেলে পার্থ ওরফে ‘বাপ্পা’র ফাঁকির জো নেই।

‘ওরা সারা দিন পানি স্পর্শ না করে আছে, আমি কী করে খাই!’ ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর হলো পার্থও রোজা রাখতে শুরু করেছেন।

স্বামীর খেয়ালটুকুকে মর্যাদা দিতে ভোরের সেহ্‌রির আগে চা-রুটি করে দিতে রাত দুটোয় ঘুম থেকে উঠছেন পার্থর স্ত্রী পাপিয়া। গত বছর রমজানে ব্যবসার কাজে বেশ কিছুদিন হৃষিকেশে ছিলেন পার্থ। পবিত্র হিন্দু তীর্থেও রোজার রুটিনে নড়চড় হয়নি।

বারাসতে দেশান্তরী খুলনার বসু পরিবার অবশ্য কল্পনাও করেনি তাদের ভাগ্যের সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে যাবে একটি মসজিদ।

১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গার আগে কোনো দিন ‘ইন্ডিয়ায় থিতু হব’ ভাবেনইনি কেউ। পার্থর ঠাকুরদা প্রয়াত নীরদকৃষ্ণ বসু পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হাতের ‘খিদমত-ই-পাকিস্তান’ খেতাবধারী।

চট্টগ্রাম বন্দরের গেজেটেড অফিসার ছিলেন। খুলনার ফুলতলার আলকা গ্রামের বোসদের জীবনে গভীর ঘা রেখে গিয়েছিল তখনকার ঘটনা। রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচতে টানা ১১ দিন দফায় দফায় পুকুরে ডুব দিয়ে মুখটুকু তুলে লুকিয়ে ছিলেন এ বাড়ির ছেলে মৃণালকান্তি।

নীরদকৃষ্ণের সেজো ছেলে নারায়ণ কৃষ্ণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। তাকে হত্যা করে ওরা ফের চড়াও হবে ভেবে গলায় ফাঁস দেন তার স্ত্রী গৌরী। নীরদকৃষ্ণ ও তার ভাই বিনোদবিহারীর সন্তানেরা এরপরই বারাসতের ওয়াজুদ্দিন মোড়লের বিশাল সম্পত্তি পালটাপালটি করে এ পারে চলে আসেন।

যে জমির মালিকানা মিলেছে, তাতে যে একখানা মসজিদ রয়েছে তা অবশ্য প্রথমে কেউ খেয়াল করেননি। জমির পর্চাতেও কিছু লেখা ছিল না। মেরেকেটে তিন কাঠা জায়গা। ভাঙাচোরা পোড়ো মসজিদটা কবেকার মধ্যযুগের তা বলতে পারেনি কেউ।

সাপখোপের ভয়ে কেউ ভেতরেও ঢুকত না তখন। ‘ও রাখা না-রাখা সমান’ বলে মাথা ঘামাতেই চাননি সাবেক মুসলিম মালিকরা। কিন্তু বাদামগাছের ধারের মসজিদে ভক্তি ভরে বাতি জ্বেলে নীরদকৃষ্ণের স্ত্রী লীলাবতীর মনটাই অন্য রকম হয়ে গেল। ‘এ মসজিদে বাতিধূপের যেন অভাব না হয় বাবা,’ ছেলেদের বলেছিলেন তিনি।

গুটিকয়েক রাজাকারের অত্যাচারের জন্য ধর্ম ও তার মানুষদের দোষ দিতে পারব না। কিছু মানুষের বিশ্বাসের স্মারক ধর্মস্থানের অমর্যাদা হতে দেওয়াও তো সম্ভব নয়! — এটাই ছিল নীরদকৃষ্ণের জীবনদর্শন।

বোসেদের হাতে মসজিদ তাই নতুন প্রাণ পেল। নিজেরা কখনও ধর্ম পাল্টানোর কথা ভাবেননি। বিশ্বাসী হিন্দু পরিবার নিজের ধর্মাচরণ বজায় রেখেছে। শুধু ক্ষুদ্রতাকে প্রশ্রয় দেননি তারা।

‘লোক দেখানো বাড়াবাড়ি মানি না। এটুকু বুঝি, একসঙ্গে জড়িয়ে বাঁচায় সমস্যা নেই!’— স্মিত হাসেন পার্থর বাবা দীপকবাবু। ধীরে ধীরে সাধ্যমত মসজিদ সংস্কারের পথে হেঁটেছেন বসুরা।

মসজিদের গায়ে বড় হরফে লেখা, ‘প্রভুকে প্রণাম কর’! তার পাশে, ‘আমানতি মসজিদ’। এ বসু পরিবার আবার চট্টগ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার ভক্তির পীরবাবা আমানত আলি শাহের মুরিদ (শিষ্য)। তার নামে হুজুরঘরও গড়ে উঠেছে। বসুদের পারিবারিক সংস্কৃতির সঙ্গেও ক্রমশ একাকার এ মসজিদ।

এ বাড়ির কেউ মারা গেলে, তাকে একবার ঠিকই নিয়ে আসা হবে এখানে। শ্মশানে শেষযাত্রার আগে আজান দেবেন ইমাম সাহেব। বিয়ের পর নতুন বউকেও প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি ঢোকার আগে মসজিদে আসতে হবে।

আর এ বাড়িতে নবজাতকের অন্নপ্রাশনের দস্তুর নেই। তার বদলে মসজিদে ইমাম সাহেবের হাতে একটু পায়েস মুখে দেওয়ার রীতি। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষের উসকানির কাছে হার না-মানা পারিবারিক মূল্যবোধেরও আমানত এ মসজিদ-প্রাঙ্গণ।

আড়াই দশক আগে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়ে তখন তোলপাড় সারাদেশ। নিঃশব্দে উলটো পথে হাঁটছিল, এ মফস্বল মহল্লা। টালির চাল, বাঁশে ঘেরা মসজিদ ফের চাঙ্গা করে তুলতেই নতুন করে ইটের গাঁথনি বসছিল তখনই।

পার্থ, তার জেঠতুতো দাদা-ভাইরা ভরসন্ধেয় দল বেঁধে মসজিদেই পড়ে থেকে পাহারা দিতেন। বাপ-জ্যাঠাদের কড়া আদেশ, তাদের এ পারিবারিক মসজিদটিতে কোনো আঁচড় যাতে না পড়ে।

পড়েনি, বলা বাহুল্য। এমন জাগ্রত মসজিদের কোনো ক্ষতি প্রাণে ধরে কেই বা হতে দেবেন! পাড়াপড়শি সবার বিশ্বাস, এ মসজিদই তাদের রক্ষাকর্তা।

রাজনীতির ঝড় বাদলের কোনো অভিঘাত এখানে ছাপ ফেলতে পারেনি। দীপকবাবু কেরোসিনের ডিলার। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যৎসামান্য টাকা রেখে এখনো বারো আনাই উজাড় হয় মসজিদের যত্নে।

এ বোসবাড়িরই ছেলে বম্বের প্রয়াত ফিল্ম ডিরেক্টর দিলীপকুমার বসু। তুতো ভাইরা মিলে ভাগাভাগি করে মসজিদের চেহারা ফিরিয়েছেন। ইমাম, মুয়াজ্জিনদের ডেকে এনে বসানো হয়েছে। সঙ্কটে-সমস্যায় হিন্দুরাও আসেন। কিন্তু কবচ-তাবিজ বিক্রির কোনো প্রশ্ন নেই।

‘বিশ্বাস বিশ্বাসের জায়গায় থাকুক! ধর্মব্যবসা কিন্তু হতে দেব না,’ জোর গলায় বলেন দীপকবাবু। অনেক বছর আগে তাবিজ-মাদুলি বিক্রির দোষে এক ইমামকে বরখাস্তও করেছিলেন বসুরা।

তিনি পালটা ঘোঁট পাকাতে গেলে ‘বোসবাড়ির মসজিদ’ শুনে কেউ সে অভিযোগে আমলই দেননি।

কেউ যাতে আঙুল তুলতে না-পারে, তাই এ মসজিদে নগদ অনুদান গ্রহণেরও নিয়ম নেই। নানা ব্যবসায় জড়িত থাকলেও স্থানীয় মুসলিমদের জমিতে হাত দিতে হতে পারে ভেবে প্রোমোটারি এড়িয়ে চলেন বসুরা।

একটি প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠনের তরফে একবার মসজিদের দায়ভার কাঁধে নেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। বসুরা তাদের বসিয়ে চা খাইয়েছেন। আর ‘এ প্রাণের মসজিদ কী করে ছেড়ে থাকব’— সবিনয় নিজেদের অপারগতাটুকু বুঝিয়েছেন।

ইফতারেও রাজনীতির ছোঁয়াচ লাগার জো নেই। কোনো নেতানেত্রীকে ডাকা হয় না। ‘ইফতার-পার্টি’ শব্দটাতেই ঘোর অ্যালার্জি পার্থর। ‘ইফতারের আবার পার্টি কী? এখানকার রোজাদারদেরও জাঁকজমক ভরা মোচ্ছব এড়িয়ে চলতেই অনুরোধ করা হয়!’

ইফতারের সময় তবু আনন্দের হাট বয়ে যায়। সন্ধ্যায় ইমামের কোরআন পাঠের আসরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভিড়। পার্থ বলেন, ‘আমরা মানি, কোরআন কিন্তু শুধু মুসলিম নয়, সবার পড়ার জন্য!’

সাতাশের রোজার দিন পড়া সম্পূর্ণ হলে সাধ্যমত চাঁদা তুলে পাড়ার সবাইকে মাছ-ভাত খাওয়ান নিয়মিত রোজাদাররা। বিকেলে ইমাম আখতার আলি আসেন মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে। সন্ধ্যায় তারাবির নমাজ শুরুর আগে মসজিদে বসে এক প্রস্থ মাছ-ভাত খেয়ে ওঠেন। কিন্তু পিতৃপ্রতিম দীপকবাবু আশপাশে থাকলে, তার মুশকিল।

এক টিপ খইনি মুখে দিতেও আখতার ভাইকে আড়াল খুঁজতে হবে। ধরা পড়লে বকুনি। সবার গার্জেন দীপকবাবুর স্নেহের শাসন জারি থাকে সারাক্ষণ।

ধর্ম-রাজনীতির খোপকাটা যাপন এখানে অবান্তর! বারাসতের অখ্যাত মহল্লায় তিন কাঠার জমির ভারতবর্ষ নিরন্তর বলে চলেছে, ‘একসঙ্গে বাঁচবই’!

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা