পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর এখন ‘রুশপুর’

পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর। ২০১৫ সালে এখানে ছিল শুধু কাঁটাতারের বেড়া। চারদিকে ধু-ধু ফাঁকা মাঠ আর দু-একটি অস্থায়ী স্থাপনা। এরপর ২০১৭ সালে সেখানে আবার গেলে দেখতে পাই কিছু দোকানপাট, পাকা ভবন। মানুষের আনাগোনাও তখন আগের চেয়ে বেশি। সর্বশেষ গত সপ্তাহে (১০-১১ অক্টোবর) রূপপুরে গেলে দেখা যায়, আমূল পাল্টে গেছে এলাকা-বিপণী বিতান, বিদ্যালয়, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট-কী নেই! কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর পুরো এলাকা।

এ পরিবর্তনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। শুধু রূপপুর নয়, পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদীতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া। পাল্টে গেছে জীবনচিত্র। বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়াও লেগেছে জীবনে।

পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালনশাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে চলছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বিপুল নির্মাণকাজ। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ শুরুর পর থেকে বদলে যেতে থাকে এলাকার চিত্র।

রূপপুর প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার বেকার যুবক। তাদের ভাগ্য যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে সামাজিক চিত্রও। রূপপুর প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস জানান, তাদের এখানে কমবেশি ২০ হাজার প্রকৌশলী-শ্রমিক কাজ করছেন। রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই হাজার বিদেশি শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। বাকিরা এ দেশের।
এর বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো লোকের। বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণী বিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপার শপ, রিসোর্ট ও তারকা হোটেল।

সাঁড়াগোপালপুর গ্রামের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, রূপপুর প্রকল্পে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ায় দোকানে প্রায়ই নতুন নতুন ক্রেতা আসছেন, আগের চেয়ে ব্যবসা ভালো হচ্ছে।

প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি একটি গ্রীণ সিটি গড়ে তুলেছে সরকার। ২০তলা করে গড়া ২০টি ভবনে থাকছেন প্রকল্পের কর্মীরা।

বিদেশি বিশেষ করে রাশিয়ার নাগরিকদের আনাগোনা স্থানীয় জীবনযাপনে প্রভাব ফেলেছে। রূপপুর আর সেই রূপপুর নেই। হয়ে উঠেছে ‘রুশপুর’। এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থাপনায় রুশ সংস্কৃতির ছোঁয়া। সাইনবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে রুশ ভাষা। রেস্তোরাঁর নাম রাখা হয়েছে- ‘রাশিয়ান ডাইন’, ‘মস্কো হোটেল’। রয়েছে ‘মস্কো টাওয়ার’ও।

এলাকার রিসোর্টগুলোতে অনেক রুশ নাগরিককে অবসর কাটাতে দেখা গেছে। স্থানীয় স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টে নির্মিত বিভিন্ন ভাস্কর্যে রুশ সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পাল্টে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা : প্রকল্পের কারণে উপজেলার প্রায় সব এলাকার রাস্তাঘাট নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় পরিবর্তন।

ঈশ্বরদী উপজেলা প্রকৌশলী এনামুল কবীর জানান, প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই উপজেলায় ১০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। নতুন করে ঈশ্বরদীতে ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে।

পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহিদুল ইসলাম জানান, রূপপুর প্রকল্পের ভারী মালপত্র রেলপথে আনা-নেওয়ার জন্য ৩৩৫ কোটি টাকা খরচে ২৬ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে।

কমেছে অপরাধ: বাঘইল গ্রামের মধ্যবয়সী সমাজকর্মী নজরুল ইসলাম বিশ্বাস বলেন, অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ, দেনা-পাওনার নালিশসহ নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার সালিশ করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সে পরিবেশ নেই। পারিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে। এলাকার মানুষও শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন।

পাবনার ঈশ্বরদী থানার একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, এই এলাকায় পারিবারিক কলহ নিয়ে আগে প্রায়ই অভিযোগ আসত। এখন এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যা খুবই কম।

উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এই এলাকায়।

১৯৬১ সালে রূপপুরে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পেরোলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলে উদ্যোগটিতে গতি আসে। চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরুর ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। পুরোদমে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর।

এক হাজার ৬২ একর জমির ওপর স্থাপিত ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে থাকছে দুটি ইউনিট। প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০২২ সালে। পরের বছর চালু কথা রয়েছে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট। আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে রাশিয়া।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান সমকালকে বলেন, রূপপুর প্রকল্পের কারণে পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে গেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে। এই প্রকল্প জাতির জন্যও একটি গর্বের বিষয়। প্রযুক্তির দিক দিয়ে এই প্রকল্পের কারণে জাতি কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।