ফের বিশ্ব মিডিয়ায় দৌলতদিয়ার সেই বৃহৎ যৌনপল্লী (ভিডিও)

ঢাকার অদূরে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাটে গড়ে ওঠা দেশের সর্ববৃহৎ যৌনপল্লী। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী এটিই। পদ্মার নির্মল হাওয়া আছড়ে পড়ে এর কাচা-পাকা টিনসেটের তৈরি ঘরগুলোতে। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা দৌলতদিয়ার এই যৌনপল্লীতে শিশু থেকে পৌড় বয়সের প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী রয়েছে।

গোয়ালন্দ ঘাট রেলস্টেশন থেকে একটু হাঁটলেই কাঁচা পাকা বেশকিছু টিনের ঘরের দেখা মিলবে। পুরো গ্রামের চারপাশেই ঘরগুলো সারি সারি সাজানো। গ্রামটির প্রধান রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই দেখা যাবে ময়লার ভাগাড়, একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে কনডমের মোড়ক, পচা কাপড় চোপড়, প্লাস্টিকসহ মাদক গ্রহণের পাত্র দিয়ে ছোট ডোবা ভরে এই ভাগাড় তৈরি হয়েছে। পাড়ার ভেতর ঢুকলেই দেখা মিলবে অলিতে গলিতে পরীদের (যৌনকর্মী) হৈ-হুল্লোড়।

হাঁসি, তামাশা, খুঁনসুটি চলছে হরদম। আবার অশালীন, অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তিও (গালমন্দ) কাটছে কেউ কেউ। কানে ভেসে আসছে গেল রাতে খদ্দেরদের বিষয়ে নানা কথাও। কোন বাবু কত বকশিস দিল, কোন বাবুর স্ত্রী কেমন-এমনই আলাপে ওরা একেবারে জমিয়ে তুলছে।

পাড়ার ঠিক মাঝখানটায় একটি মাত্র খাবার হোটেল। খুপড়ি ঘরগুলোর সঙ্গে মেলানো যায় হোটেলটির কাঠামো। ভাত মিলছে সকাল বেলায়ই। হরেক রকম ভর্তা থরে থরে সাজানো। তবে ডাল-পরোটা জুটছে চাহিদা মতো।

এখানে যেসব শয্যাসঙ্গী পাওয়া যাবে তাদের মধ্যে কারো জন্ম এই পাড়াতে আবার কাউকে পাচার করে আনা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। তেমনি একজন কিশোরী তিথী, যাকে ঢাকা থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসে এক প্রতিবেশি। পরে এই যৌনপল্লিতে তাকে বিক্রি করে দেয়।

তার ভাষায়, ‘পাড়াপড়শি তো তাই তার কথায় এসেছি। শুনছি এহেনে আনার পর খালার (সর্দারনী) কাছে ৩০ হাজার টাকায় বেচে দিয়েছে। যতদিন ওই টাকা শোধা না হবি ততদিন এহেনে থাকতে হবি। প্রথম দিকে খুবই কষ্ট হতো, মনে হতো আত্মহত্যা করি। এখন অবশ্য সহ্য হচ্ছে।’ এভাবেই তিথী তার স্বাভাবিক জীবন থেকে যৌনকর্মী হয়ে উঠার গল্প শোনালেন।

দৌলতদিয়ায় রাত বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খদ্দেরের সংখ্যাও। তাই তো, এই নিশিকন্যাদের ব্যস্ততা বাড়ে। সাজের বেলায়ও যে ওরা উদাসীন নয়, তা প্রত্যেকের রূপেই প্রকাশ ঘটে। রঙচটা মেকআপ বদনজুড়ে। বসনের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক।

ঢাকা থেকে অপহৃত হয়ে দৌলতদিয়ায় আশ্রয় হয় তিথীর

লিপস্টিকের রঙে মিলিয়ে কপালে ছোট-বড় টিপ। কড়া পারফিউম, যেন নিশিকালে কামিনী ফুলের সুবাস বইছে। বাহারি দুল শোভা পাচ্ছে কানের লতিতে। কারও কারও কানে একাধিক রিং। মন মাধুরী মিশিয়ে চুল বেণি করতে যে বেশ সময় নিয়েছে ওরা, তা গাঁথুনি দেখেই ঠাওর করা যাচ্ছিল। বয়সীরা বেশিরভাগই খোপা বাঁধা। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি বাজছিল কারও কারও হাঁটার তালে।

শুধু যে নিজেদের সেজে রাখে তা নয়, রুমটিও বাহারি ধরনের কাগজে সাজায় তারা। তিথী জানায়, ‘এসব কাগজে ঘরটা সাজিয়ে রাখতে হয়, যেন কাস্টমাররা খুশি হন।’

এই পল্লীর অধিকাংশ কাস্টমার হলো দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের ট্রাক চালকরা। এখানে খুব সস্তায় যৌনকর্মী ভাড়া পাওয়া যায়, যৌনপল্লীতে আসা একজন যুবক জানান, ‘১০ বছর থেকে শুরু করে ৩০/৪০ বছরের মাইয়া আছে; তাদের পেতে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকাও গুনতে হয়।’

পাড়ার মাঝখানে ঠিক ওই হোটেলটির পাশেই রয়েছে জুয়ার বোর্ড। হাক ছাড়ছে জুয়াড়িরা। সেই সাথে মাদক বিক্রিও হয় এখানে। এর আশপাশ ঘিরেই কয়েকটি ডিসকো ঘর। তাতে একাধিক বিছানা পাতা। বাবুদের আয়েশের জন্য আছে কোলবালিশও। সেখানে মদ মিলছে, মিলছে বাইজি নাচও। যারা নাচছে, তারা পাড়ার-ই যৌনকর্মী। খদ্দেরের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা থাকলেই কেবল এমন নাচ দেখায় ওরা।

এখানে সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের সামনেই খদ্দেরকে আনন্দ দেয় যৌনকর্মীরা। ১০ ও ১২ বছর বয়সী শাহিন ও রনি তাদের মা শেফালিও ছিলেন যৌনকর্মী, আর বাবা শেফালির খদ্দের ছিলেন। যাতায়াত করতে করতে এক সময় তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়; পরে বিয়ে। শেফালি সংসারে এখন ছয় সন্তান, তাদের মধ্যে ৩ মেয়েই যৌনকর্মী। শেফালির ভাষায়, ‘তিন মেয়ের ধান্ধাতেই (যৌনকর্ম) সংসার চলে।’

খদ্দেরকে বাগে আনছিলেন এই নিশীকন্যা

শেফালীর বড় মেয়ে খুশি, সে-ও একজন যৌনকর্মী। ছোট ভাই বোনদের সামনে এই কাজ করতে খারাপ লাগে না বা তারা কিছু মনে করে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা ছোটবেলা থেকেই দেখে অভ্যস্ত। মাকেও দেখেছি এই কাজ করতে। খারাপ লাগলেও করার কিছু নেই। কারণ, সংসার চলে আমার টাকায়।’

কোনো খদ্দেরকে আপনার ভালো লাগে না, তাকে ভালোবাসেন না? ‘ভালো লাগলেই তো আর হয় না, আর ভালোবাসি না। কারণ, এখানে যারা আসে তারা বিয়ের পর বউকে মার-ধর করে। আর কখনো যদি বাইরে যাই, তাহলে কাউকে বিয়ে করে নেব।’ -জানান খুশি।

পাশেই রয়েছে কে কে এস শিশু সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যেখানে যৌনকর্মীদের শিশুরা পড়তে যায়। শাহিন ও রিন এই স্কুলেই পড়ে। তাদের শিক্ষিকা রিনাও এক সময় যৌনকর্মী ছিলেন। পরে এক বিদেশি এনজিওর তত্ত্বাবধানে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। তার ভাষ্য, ‘এখন আমার এক মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে, বেশ চলছি চাকরির বেতনে।’

যৌনকর্মের এই অসহ্য যন্ত্রণা ভুলতে অনেকেই মাদক জাতীয় ওষুধ সেবন করেন। সমাজে পুরুষরা তাদের আনন্দের জন্য ব্যবহার করে থাকলেও, ভালো চোখে দেখে না। এমনকি তাদের কারো মৃত্যু হলে কবর দেয়ারও লোক পাওয়া যায় না। এমনকি নিষ্পাপ শিশুকে মাটি দিতে মানুষ ভাড়া করতে হয় এই যৌনপল্লীতে!

নয় বছর আগে চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে অপহরণ হয়ে এসে ঠাঁই হয় রিতার। এখন চল্লিশের ঘরে পা রেখেছেন। মেয়ে পিংকিকে (১৯) বাসে তুলে দিয়ে চায়ের দোকানে এসে বসেছেন। পরিচয় দিয়ে আলাপ তুলতেই বলেন, ‘নটী (যৌনকর্মী) গো কথা শুনে কী করবেন? সাম্বাদিক (সাংবাদিক) গো লগে গপ্প (গল্প) করলে তো পেটে ভাত যাইব না। দেখলেন না, মেয়েরে ঢাকায় পাঠালাম (পাঠালাম)। ঢাকার হোটেলে কাজ করলেই ভালো বকশিস পায়। ঢাকার বাবুরা আর এহানে আইতে চায় না। দিনে দিনে খদ্দের খালি কমতাছে।’

বলেন, ‘আমরা আর আগের মতো ভালো নেই। মানুষ ভালো থাকলেই তো আমরা ভালো থাকি। দেশের অবস্থা তো আমরাও কিছুটা বুঝতে পারি। বাজারে গেলেই মানুষের পকেট খালি হয়ে যায়। এনে (এখানে) ফূর্তি করতে আইতে তো ট্যাকা লাগে। দিনভর অপেক্ষা করেও দুজন বাবু মেলাতে পারি না। যারা আহেন তারা আর আগের মতো বকশিশও দেয় না। গতর খেটেই দিন পার।’ সূত্র: আল জাজিরা।