বগুড়ার কামারপল্লীতে লকডাউনে কমেছে ঈদের ব্যস্ততা

প্রযুক্তির প্রসার ও সময়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে কামার শিল্প। তার মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কামার পল্লীতে চলমান লকডাউনে ঈদুল আজহাকে ঘিরে কমেছে কাজের ব্যস্ততা।

অথচ করোনা পরিস্থিতির পূর্বে দিনরাত কোরবানির পশু জবাই ও গোশত কাটার বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতেন কামার শিল্পীরা। তাদের দম ফেলার ফুরসত ছিলোনা। লকডাউনের কারণে কাক ডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন কামার পল্লীগুলোতে লোহার সাথে হাতুড়ির টুং টাং শব্দ সীমিত হয়ে এসেছে। অনেকে আবার এই ঐতিহ্যবাহী পেশা বদলে ফেলেছে।

ঈদের দিন চাহিদামত কসাই না পাওয়ায় শিবগঞ্জের সিংহভাগ কোরবানিদাতা নিজেরাই পশু কোরবানির কাজটি করে থাকেন। এ কাজের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ধারালো চাপাতি, ছুরি, বটি ও দা।

করোনা মহামারির আগে ঈদকে সামনে রেখে এলাকার মোড়ে মোড়ে চাপাতি, ছুরি, বটি ও হাসুয়া, ভূজলী, কুড়ালের পসরা সাজিয়ে বসতেন কামার শিল্পিরা। এবার এমন চিত্র চোখে পরছেনা।

সারাবছর খবর না থাকলেও প্রতিবছর ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এসব ধাতবযন্ত্রের জন্য যেতে হয় কামার পল্লীতে। আবার অনেকে এসব সরঞ্জামে শান দিতেও ভিড় করে কামার পল্লীতে।

এই উপজেলার কামার শিল্পীদের তথ্য মতে, উপজেলার বিভিন্ন বাজার ও গ্রামে রয়েছে পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি কামারের দোকান। এসব দোকান বেশির ভাগ উপজেলার নারায়নপুর গ্রামের কর্মকারদের।

নারায়নপুর গ্রামের কামার শিল্পী বাবলু কর্মকার বলেন, আমাদের গ্রামের প্রায় ৩০পরিবার এই কামার শিল্পের সাথে জড়িত। তারা উপজেলার বিভিন্ন বন্দর ও বাজারে ব্যবসা করে আসছে।

গত শনিবার বিকেলে সরেজমিনে শিবগঞ্জ পৌর এলাকার নিমতলার প্রদীপ কর্মকারের সাথে কথা বলার জন্য তার দোকানে গেলে দেখা যায়, অনেকটা ক্রেতা শূণ্য হয়ে বসে আছেন তিনি। কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দৈনিক জয়যুগান্তরকে বলেন, আমি ১৯৭২ সাল থেকে এই ঐতিহ্যবাহী পেশার সাথে যুক্ত আছি। হামার ও হাতুড়ির শব্দ আমাদের হৃদয়ের সাথে গেঁথে আছে। লকডাউনের কারণে এবার বেচাকেনার কোন উত্তাপ নেই। আমাদের কাজের পরিধি অর্ধেকে নেমে এসেছে।

শিবগঞ্জ কালীপাড়ার মিলন কর্মকার বলেন, সাধারণত স্প্রিং লোহা ও কাঁচা লোহা ব্যবহার করে চাপাতি, দা, বটি ও ছুরি তৈরি করা হয়। স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণের মান ভালো, দামও বেশি। আর কাঁচা লোহার তৈরি উপকরণগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম। একটা চাপাতি গড়ে ৫০০টাকা থেকে ৮০০টাকা, রাম দা ৫০০টাকা থেকে ১০০০টাকা, ছুরি ১৫০টাকা থেকে ৬০০টাকা এবং বটি ১৫০টাকা থেকে ৫৫০টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। এবার ঈদে অর্ডার স্বল্পতার কারনে আমাদের ব্যবসা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পরেছে।

শিবগঞ্জ পৌর এলাকার চিকাদহ এলাকার ব্যবসায়ী গৌড় কর্মকার বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর হলো শিবগঞ্জ উপজেলার কিচক, কাহালু উপজেলার কালাই ঘোনপাড়া ও জয়পুর হাটের মোসলেমগঞ্জ থেকে পাইকারী অর্ডারে চাপাতি, দা, বটি ও ছুরি বিক্রি করি। এবার তেমন বেচা বিক্রি নেই।

বানাইলের শ্রী বিবরণ কর্মকার বলেন, করোনা ভাইরাসের শুরু থেকে দিনে ৩শত-৪শত টাকা আয় হলেও ঈদের কারণে তা একটু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১হাজার টাকায়। তার মতে, বর্তমান সময়ে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির স্টিল জাতীয় জিনিষের ভিড়ে আমাদের লোহার তৈরি জিনিষের কদর কমে যাচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। তার দাবি, কর্মকারদের একটি সংগঠন থাকলে সুবিধা হতো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার মীরেরচক, আটমূল, ভাইয়েরপুকার ও আলীগ্রামের ততোধিক বাসিন্দা জানায়, চলমান লকডাউনে আমাদের আয় রোজগার কমে যাওয়ায় এবার কুরবানি দিতে পারবোনা। আমরা আগে ঢাকায় চাকুরী করতাম এখন চাকুরী হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

ছুরিতে শান দিতে আসা ক্রেতা স্বপন মিয়া ও রঞ্জু বলেন, কুমারদের দোকানে মূল্য তালিকা থাকলে ভালো হতো। তুলনামূলক এবার কাজের মজুরী একটু বেশি মনে হচ্ছে। তবে ভির কম থাকায় কম সময়ে কাজ করতে পেরেছি।