পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি ও সহাবস্থানের জন্য সারা বিশ্বে মডেল

বর্ণিল আয়োজনে খাগড়াছড়িতে পালিত হয়েছে পার্বত্য শান্তিচুক্তির রজতজয়ন্তি

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বর্ণিল আয়োজনে পালিত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির রজত জয়ন্তি তথা ২৫বর্ষপূর্তি।

শুক্রবার (২রা ডিসেম্বর) সকালে জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার শুভ উদ্বোধন করেন ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি।

বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের র‍্যালিটি সড়ক প্রদক্ষিণ করে শাপলা চত্বর হয়ে টাউন হল প্রাঙ্গণে এসে চেতনা ম্যুরাল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা শেষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বর্ণিল ডিসপ্লে সবাইকে মুগ্ধ করে।

পাহাড়ী জনগোষ্ঠী যদি সে সময়ে তাদের রাগ ক্ষোভ ও আশা আকাঙ্ক্ষার কথা সরকারকে প্রকাশ না করত তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এত অগ্রসর হত না। প্রধানমন্ত্রীর পাহাড়ের মানুষের প্রতি আন্তরিক তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত করে পাহাড়ের মানুষের জন্য কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজত জয়ন্তি’র উদ্বোধনীয় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা আরও বলেন, পাহাড়ের মানুষ সারা বিশ্বে শান্তি ও সহাবস্থানে কি ভাবে থাকতে হয় তার নজির স্থাপন করেছেন। পাহাড়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা ধরে রাখতে পাহাড়ী বাঙ্গালীর মধ্যে সম্প্রীতি ও এলাকার আইনশৃক্সখলা বজায় রাখতে সকলের সহযোগীতা চান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: জাহাঙ্গীর আলম, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রফু চৌধুরী অপু, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা, বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, ডিজিএফআইয়ের ডেট কমান্ডার কর্নেল সরদার ইসতিয়াক আহমেদ, জেলা পুলিশ সুপার মো: নাইমুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) গোলাম মুহম্মদ বাতেন, রজত জয়ন্তী উদযাপন কমিটি’র আহবায়ক জেলা পরিষদের সদস্য কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া, নিলোৎপল খীসা, পার্থ ত্রিপুরা জুয়েল, শুভ মঙ্গল চাকমা, হিরনজয় ত্রিপুরা, খোকনেশ্বর ত্রিপুরা, জেলা পরিষদের সদস্য শতরূপা চাকমা, জেলা সিভিল সার্জন মো: ছাবের, বিভাগীয় কর্মকর্তা মো: হুমায়ুন কবির সময়, জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো: মনিরুল ইসলাম, জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো: সাইফুল্লাহ, জেলা পরিষদের জনসংযোগ কর্মকর্তা চিংলামং চৌধুরীসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তারা।

এদিকে পাহাড়ের ভূমি সমস্যা নিরসনে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নপূর্বক দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলােকে ১৯০০সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি কার্যকর রাখা। আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার কার্যাবলী ও ক্ষমতা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে হস্তান্তর করাসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। পার্বত্য চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার(২রা ডিসেম্বর) দুপুরে জেলার মহালছড়ি উপজেলার করল্যাছড়ি এলাকার স্কুল মাঠে আয়োজিত সমাবেশে এসব দাবির কথা বলেন সংগঠনের নেতারা।

আয়োজিত সমাবেশে কেন্দ্রিয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, ১৯৯৭সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, এই সুদীর্ঘ সময়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই তৃতীয়াংশ ধারাগুলোই অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে।

উদ্বেগের বিষয় যে, ২০০৯সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারীরা আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এক যুগের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আগের মতই অবাস্তবায়িতই রয়ে গেছে।

আইন বিষয়ক সম্পাদক সুদর্শন চাকমা জানান, আজকে পার্বত্য চুক্তির ২৫বছর পূর্তি উদযাপন করছি প্রতিবাদের সাথে। এতো বছর পরেও সরকার আমাদের ধারাগুলো অবাস্তবায়ন অবস্থায় পেলে রেখেছে। এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন করে। তাহলে শান্তি ফিরে আসবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন বিষয় ও কার্যাবলী কার্যকরণ এবং উক্ত পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন এর বিধিমালা চূড়ান্তকরণ, আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও তাদের নিজস্ব জায়গা-জমিতে পুনর্বাসন, অনুপ্রবেশকারী বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন, চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সংশােধন, অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকলচাকুরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়ােগ ইত্যাদি বিষয়গুলাে বাস্তবায়নে সরকার অদ্যাবধি কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজতজয়ন্তি তথা ২৫বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিকেল ৩টায় অস্ত্র সমর্পণের স্থান খাগড়াছড়ি ঐতিহাসিক স্টেডিয়ামে হয়েছে সম্প্রীতি কনসার্ট। কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেন ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ বেগম এমপি।

এছাড়াও সংগীত পরিবেশন করেন হৃদয় খান, নাজমা সুইটি, প্রতীম, অরণ্য ব্যান্ড ও হিল স্টার মিউজিক্যাল গ্রুপ। এ কনসার্ট সকলের জন্য উম্মুক্ত থাকবে। এছাড়াও একই স্থানে সন্ধ্যায় থাকবেন প্রদীপ প্রজ্জলন, আতশবাজি ও ফানুস উড়ানো।

উল্লেখ্য, পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭সালের এই দিনে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮সালের ১০ই ফ্রেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এর পর কেটে গেছে ২৪বছর।

চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাও বাস্তবায়িত হবার পথে। তাও পাহাড়ি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পাহাড়িদের ৬টি সশস্ত্র সংগঠনের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড় । এসব সংগঠনের অপতৎপরতায় পাহাড়ের মানুষের আশা-আকাঙ্খা সবকিছু ধূলিস্যাতে অস্থির হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, গোলাগুলির মত ঘটনায় আরো শঙ্কিত পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।

চুক্তির পর গত ২৪বছরে ৬টি পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ৮শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী এবং সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। সংঘাত সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির উপরও আঘাত হানছে। উন্নয়নের গতি বাড়াতে ৬সশস্ত্র সংগঠন নিষিদ্ধসহ চাঁদাবাজি বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি সকল মহলের।