বাংলাদেশে নির্বাচনের চিরচেনা রূপ কি হারিয়ে যাচ্ছে?

নির্বাচনের চিরচেনা রূপ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। নানা কারণে দেশে নির্বাচন হয়ে পড়ছে জৌলুসহীন ও অনেকটাই প্রতিযোগিতাহীন। অনেক নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে বিজয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আগের মতো দেখা যাচ্ছে না।

ভোটদাতারের মধ্যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা ও উৎসবের আমেজ থাকছে না প্রায়ই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা।

শুধু সরকার ও স্থানীয় সরকার পরিচালনায় নয়, দেশের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীদের সংগঠনের নির্বাচনেও প্রায় একই অবস্থা। সাধারণ নির্বাচনের মতো পেশাজীবী সংগঠনগুলোর আঙিনা থেকেও উধাও হয়ে যাচ্ছে ভোটের উত্তাপ। এমন পরিস্থিতির জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সব রাজনৈতিক দলকেই কমবেশি দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

দেশের নির্বাচনে জাতীয় সংসদের পর অন্য বড় আয়োজনটির নাম উপজেলা নির্বাচন হলেও পঞ্চম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিরুত্তাপ পরিবেশে। সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন নিয়েও ভোটারদের মধ্যে এখন তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচনও যারপরনাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হওয়ায় ছিল একেবারেই পানসে। আসন্ন এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পরিবেশে।

শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিটি চেম্বার ও খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনে আগের মতো নির্বাচন হচ্ছে না। জেলা পর্যায়ের ৬৪টি বণিক সমিতির মধ্যেও বেশিরভাগই ভোটাভুটি ছাড়া কমিটি গঠিত হয়ে আসছে।

২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হলগুলোর নির্বাচন হতে চললেও হলগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যেন হিড়িক পড়েছে। আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ওই নির্বাচনেও বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার ঢেউ লেগেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হল সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩৪টি পদের মধ্যে ৫৬টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে যাচ্ছেন প্রার্থীরা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনজীবী ও চিকিৎসকের মতো অন্যান্য কিছু পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনেও দূষণের অভিযোগ আছে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও আজকাল মারামারির অভিযোগ উঠছে। বিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনেও জাল ভোটের অভিযোগ উঠেছে।

এমন পরিস্থিতির জন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দায়ী করে আসছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর জন্য কোনো দল ও সরকারই এককভাবে দায়ী নয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেসহ বিএনপির সময় বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিতর্কিত পদ্ধতিতে। সেই সময়গুলোতে অনেক নির্বাচনই ছিল জৌলুসহীন ও একতরফা।

এ ছাড়া একতরফা নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। এ কারণেই বিএনপির আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন ছিল ভোটারহীন। একইভাবে সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও ভোট কম পড়ে।

দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ধাপে ধাপে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন চলতি মাসে অনুষ্ঠেয় হলেও অধিকাংশ এলাকায় নেই নির্বাচনকেন্দ্রিক ভোটারদের উচ্ছ্বাস। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোট ও বামদলের জোটসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। ফলে নিরুত্তাপ পরিবেশের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

ভোটের মাঠে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় লড়াই ছাড়া উপজেলা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেতে যাচ্ছেন শতাধিক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রথম ধাপে ৩০ জন, দ্বিতীয় ধাপে অন্তত ২৫ জন, তৃতীয় ধাপে ২১ জন আর বাকিরা চতুর্থ ধাপে একক প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ দফায় চেয়ারম্যান পদে ২১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে যাচ্ছেন। আগামী ১৩ মার্চ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ইসি সূত্র জানায়। বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই তাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।

সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ইসিতে যেমন জমজমাট পরিবেশ ছিল, তেমনটা দেখা যায়নি এবারের উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময়। অনেকটা নিরুত্তাপ পরিবেশে ইসি উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে।

অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি ও জামায়াতসহ সরকারবিরোধী বেশিরভাগ দল। ফলে ওই নির্বাচন নিয়ে দেশের ভোটদাতাদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহের পাশাপাশি নির্বাচনও ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নিরুত্তাপ ভোটে ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। এ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুব কম। বিশেষ করে কাউন্সিলর নির্বাচন ঘিরে ভোটারের মধ্যে যতটা উৎসাহ দেখা গেছে, সেই তুলনায় মেয়র পদের উপনির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল কম। প্রায় একইরকম অবস্থা হয় ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও। বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা তখন কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে মেয়র (অবিভক্ত ঢাকার) নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় ও মারধর করে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করায় তখন তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানো কঠিন ছিল বলে দলটির অভিযোগ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনে করেন, ‘ডিএনসিসির উপনির্বাচন ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের চেয়ে ভালো হয়েছে।’

এক সময় এফবিসিসিআই বা বিজিএমইএ নির্বাচন নিয়ে প্রায় গোটা দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা চলত। তাদের দৃষ্টি থাকত সংগঠনগুলোতে নির্বাচিত হয়ে কে আসছেন তাদের পরবর্তী নেতা হয়ে। দুটি সংগঠনের নির্বাচন নিয়েই আগের সেই উত্তাপ আজকাল আর নেই। নির্বাচন ছাড়া সমঝোতার ভিত্তিতে সংগঠনগুলোতে নেতা নির্বাচিত হন।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০০-০২ সাল মেয়াদের আগেও এফবিসিসিআইতে সরাসরি সাধারণ পরিষদের সদস্যদের ভোটে সভাপতি নির্বাচন হতো। বিএনপি-জামায়াতের সরকারের আমলে ২০০২ সালের এক আদেশে সংগঠনটির নির্বাচনে ভোট নির্বাসিত হয়ে পড়ে। ওই সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এক আদেশের মাধ্যমে ভোটের বিধানে পরিবর্তন আনেন। এরপর থেকেই সাবেক সভাপতি ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের সমর্থনে এফবিসিসিআই সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন। প্রায় একই অবস্থা পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএতেও।

২০১৩ সালের পর থেকে বিজিএমইএতে সরাসরি সদস্যদের ভোটে নির্বাচন হয়নি। বিজিএমইএ ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৬ এপ্রিল ভোট আর নির্বাচিত ও মনোনীত পরিচালকদের নিয়ে ২ মে এফবিসিসিআইয়ের বোর্ড গঠন এবং ওই দিন সভাপতি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সহসভাপতি নির্বাচন করার কথা রয়েছে।