বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত কি চাপে পড়বে?

প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে ব্যাংকিং খাত চাপে পড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিববিদরা।

তাদের মতে, এতে ব্যাংক থেকে সরকারের ধার নেয়ার পরিমাণ বাড়বে। তখন এ খাত চাপে পড়বে। তাছাড়া কাঙ্খিত হারে বিদেশি ঋণ না পেলে পুরো বাজেট ঘাটতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে ব্যাংক ঋণের ওপর। এতে সুদের হার আরো বেড়ে যাবে। এর ফলে কমে যাবে বেসরকারি বিনিয়োগ।

বিশ্লেষকদের পরামর্শ, যেহেতু ব্যাংক মালিকদের অযৌক্তিক সুবিধা দিয়ে করপোরেট কর কমানো হয়েছে তাই তাদের চাপ দিয়ে সুদ হার কমিয়ে আনতে হবে। আর সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন: ‘বাজেট মেটাতে যদি ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ নেয়া হয় তাহলে ব্যাংক খাতে চাপ পড়বে। চাপে পড়া মানে ঋণের চাহিদা বাড়বে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের প্রবাহ বাড়বে। আর ঋণের প্রবাহ বাড়লে সুদের হারও বেড়ে যাবে। কাজেই অর্থমন্ত্রী যে সুদের হার কমাবেন বলছেন, সেটা সম্ভব হবে না।’

তিনি বলেন: ‘এ খাতে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য স্বল্প সংখ্যক কিছু লোক দায়ী। কিন্তু বাজেটে তাদের তিরস্কার না করে বরং পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের মালিকদের চাপে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এ খাতের টাকা কারা নষ্ট করলো তাদের বিচার হওয়া জরুরী। সেজন্য কমিশন গঠন না করলেও অন্তত একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।’

৪ বছর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন: ব্যাংকিং খাতে সার্বিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে একটি কমিশন গঠন করবেন। ৭ জুনে প্রস্তাবিত বাজেটের ২/৩ দিন আগেও অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এ মাসের মধ্যেই ব্যাংকিং কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটের পর তিনি জানালেন, কমিশন গঠনের কাজ আগামী সরকারের হাতে দিয়ে যাবেন।’

‘তার (অর্থমন্ত্রীর) এসব কথা আমরা বুঝতে পারি না। তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন। ২/৪ দিনের মধ্যেই তিনি মত পাল্টে ফেলেন। এতে মনে হয়, তিনি ধীরস্থির মানুষ নন’, বলেন ইব্রাহীম খালেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন: ‘সরকার প্রয়োজনমত সঞ্চয়পত্র কিনলে, ব্যাংক থেকে ধার করতে হবে কম। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে অবশ্যই ব্যাংকিং খাতে চাপ বাড়বে। তখন বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের ঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে।’

‘আমি সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোর পক্ষে নই। কারণ এ খাতে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণির লোকজন বিনিয়োগ করে কিছু অর্থ পেয়ে থাকেন।’

তিনি বলেন: ‘সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমালে এ খাতে বিনিয়োগকারীরা সঞ্চয়পত্র বিমুখ হয়ে ব্যাংকে আমানত রাখতে যাবে- এমন ধারণা ভুল। কারণ তারা এখানে ঝুঁকিবিহীন কিছু স্থায়ী আয় পাচ্ছেন। অতএব তারা সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমালেও ব্যাংকে আমানত রাখতে যাবে না।’

ঋণের সুদ হার কমানোর তাগিদ দিয়ে সালেহউদ্দিন বলেন: ‘ব্যাংকিং খাতে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর হার কমানোর ফলে এ খাতের মুনাফা বাড়বে। সরকারের উচিত ব্যাংক মালিকদের চাপ দিয়ে ঋণের সুদ হার কমিয়ে আনা। কারণ তারা শুধু সুবিধা পেয়ে যাবেন কিন্তু গ্রাহকদের সুবিধা দিবে না; তা হয় না।’

তবে চাপ পড়লেও তা খুব বেশি হবে না বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন: ‘বাজেটে ব্যাংক ঋণের ওপর কিছুটা চাপ পড়বে। তবে তা খুব বেশি নয়। আর যেহেতু রাজনৈতিক চাপ রয়েছে সেক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর কমালেও বেশি কমাতে পারবে না।’

মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন: ‘ব্যাংকিং খাতে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এতে ঋণগ্রহীতা বা আমানতকারীদের স্বার্থে কোনো কিছু হবে না। ব্যাংকের মালিকরাই লাভবান হবেন।’

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।

ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা নেয়া হবে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে খেলাপী ঋণে আক্রান্ত ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা।

ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থা নিয়ে চিন্তিত ব্যবসায়ীরাও। এফবিসিসিআইএর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন শনিবার এক সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন: যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যাংকে রোবারী (লুটপাট) করছেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।

ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে তিনি বলেছেন: বাজেটের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা।

চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো নগদ টাকা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫/৬ শতাংশে নেমে আসে। বিপরীতে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। তাই বেশি মুনাফা পেতে মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। এতে ব্যাংকের আমানত কমে যায়। বেড়ে যায় সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ।

২৯ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে যায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। তাই আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।