বাবা-মেয়ের অাত্মহত্যা: আসলে কি ঘটেছিল?

কি এমন ঘটনা ঘটেছিল যে দিনমজুর হযরত আলীকে তার প্রথম শ্রেণিতে পড়া শিশুকন্যা আয়েশা আক্তারকে নিয়ে ট্রেন তলায় ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে হলো? কেন তিনি জনপ্রতিনিধি কিংবা পুলিশ প্রশাসনের কাছে গিয়েও ওই ছোট্ট শিশুকন্যার ওপর চালানো অত্যাচারের বিচার পেলেন না? মর্মান্তিক এ ঘটনার পেছনের ঘটনা খুঁজতে বের করতে সরেজমিনে ওই গ্রামে গেছে।

শনিবার সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশন থেকে কিছুটা দূরে রেললাইন থেকে বাবা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়।

পরিবারের অভিযোগ, ফারুক নামের স্থানীয় এক বখাটে হযরত আলীর মেয়ে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী শিশু আয়েশাকে একাধিকবার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে।স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল হোসেনের কাছে ঘটনার বিচার চাইতে গিয়ে পাননি।তিনি তা ধামাচাপা দেন।পরে থানায় অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি।

সেই ক্ষোভে শনিবার মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে ঘটনা স্থলেই নিহত হন বাবা-মেয়ে। হযরত আলী ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কালাই গ্রামের মৃত রিয়াজ উদ্দিন সরকারের ছেলে। তিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন।

সারাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়া এই ঘটনার একদিন পর হযরত আলী সরকার ও তার মেয়ে আয়েশা আক্তারকে সোমবার সকালে গোসিঙ্গা ইউনিয়নের কর্ণপুর গ্রামে দাফন করা হয়

গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে গেছে, হযরত আলী দিনমজুরের কাজের পাশাপাশি গরু লালন-পালন করতেন। আর তার স্ত্রী হালিমা বেগম বাসা বাড়িতে কাজ করত।নিঃসন্তান এ দম্পতি আয়েশার মাত্র একদিন বয়সেই দত্তক নিয়ে এসেছিলেন। তাদের আদর-যত্নে কেউ কখনো ভাবতে পারতো না আয়েশা তাদের পালিত সন্তান তাকে নিজেদের সন্তানের মতো লালন-পালন করছিলেন তারা।

হযরত আলীর এক প্রতিবেশী বলেন, হযরত আলী ও হালিমার কিছুটা মানসিক সমস্যা থাকায় তাদেরকে এলাকাবাসী পাগল বলতো। তারা হালিমাকে হালি পাগলি নামে ডাকতো। স্বামী-স্ত্রীর মধে প্রায়ই ঝামেলা হতো। এমনকি হযরত আলীও মাঝে মাঝে বাসা থেকে বের হয়ে যেতেন।বেশ কিছুদিন পর আবার ফিরতেন। ছয় মাস আগে কয়েকবার হযরত আলী গাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

স্থানীয় এলাকার দারুল হামিদিয়া মাদ্রাসার মোহতারাম মো: হাফিজউদ্দিন বলেন: গাছে উপরে গিয়ে একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে আলী। পরে মাদ্রাসায় এসে আমার কাছ থেকে বেশ কয়েকবার পানি পড়াও নিয়ে গেছেন। কেন গাছে আত্মহত্যা করতে যান জানতে চাইলে আলী বলেছিল, ‘‘গাছ আমারে ডাকে, গাছের কাছে যাইতে কয়’’।

প্রায় ৩০ বছর আগে দিনমজুর হযরত আলী গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুর ছিটপাড়া গ্রামের হালিমাকে বিয়ে করে। অভাব অনটনের সংসারের যোগান দিতে হালিমা ভিক্ষাবৃত্তি ও অন্যের বাড়ীতে ঝিঁয়ের কাজ করে।

আয়েশার মা হালিমা বলেন, আমার মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো ছিল, বাসার ঘরে এখনো ওর বই আছে। কিন্তু ওই ফারুক আমার মেয়েকে নির্যাতন করেছে।এর কোনো বিচার পাইনি। আমার গরু চুরি করেছে তারও কোনো বিচার পাইনি।

‘শনিবার সকালে বাপ মেয়ে নাস্তা করে এক সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়, তারপরেই ট্রেন লাইনে কাটা পড়ার ঘটনা শুনি’ এই বলেই মুর্ছা যায় হালিমা।

আয়েশার পরিবারের অভিযোগ, ফারুক কয়েকবার তাকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। এজন্য হযরত আলী ফারুকের বাবার কাছে অভিযোগ করে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ইউপি সদস্য আবুল হোসেনের কাছে গিয়েছে সেও প্রতিকার করেনি। বরং একথা শুনে ফারুক হযরত আলীর গরু নিয়ে জবাই করে সবাই মিলে ভাগ করে খায়। শেষ পর্যন্ত গত ৪ এপ্রিল শ্রীপুর থানায় অভিযোগ করেন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

আয়েশার নির্যাতন ও গরু চুরির ঘটনায় কোনো সমাধান পায়নি কেন হালিমা জানতে চাইলে গোসিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহ্বাজ শাহজাহান সরকার বলেন, আমার কাছে কোনো অভিযোগ নিয়ে হালিমা আসে নি। তবে এলাকার মেম্বারের কাছে যেতে পারে।আর বখাটে ফারুককে আমি চিনি না। জেনেছি ও পলাতক। ও যদি দোষী হয় অবশ্যয় আমরা দোষীর উপযুক্ত বিচার চাইব।

অপরাধী ফারুক সম্পর্কে জানতে চাইলে এলাকাবাসী জানায়: ফারুকের চরিত্র ভালো না, নেশা করে। এছাড়াও দুইটা বিয়েও করেছে।তবে হালিমার পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই উঠাবসা ছিল ফারুকের। ওর সাইকেলে বেশ কয়েকবার আয়েশাকে উঠতেও দেখা গেছে। একবার সাইকেলে উঠে আয়েশার পা চেইনে পরে কেটে গিয়েছিল।

অবশ্য গ্রামবাসীদের অনেকেই বলেছেন, ফরুক হোসেন প্রভাবশালী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আর হযরত আলীর কথাও গুরুত্ব দেয়নি কেউ। যার কারণেই এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে।

শ্রীপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামান বলেন: হালিমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু থেকেই ফারুককে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া হালিমা বিচার চাওয়ার পর এলাকার মেম্বার আবুল হোসেনের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় রেলওয়ে পুলিশ ইতিমধ্যে এ হত্যা মামলার আসামী করে গ্রেফতার করেছে আবুল হোসেনকে। তবে তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।-চ্যানেল আই অনলাইন