বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ‘বাধা’ ব্যাটারিচালিত রিকশা

অবৈধ ঘোষণা দিয়ে বার বার বন্ধের উদ্যোগ নিলেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। সাধারণ প্যাডেলচালিত রিকশার মতো দেখতে হলেও সিটের নিচে ব্যাটারি ও চেনের সঙ্গে মোটর সংযুক্ত করে চলছে অলিগলিতে। একদিকে এসব রিকশার বেপরোয়া গতির কারণে যেমন হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনি অবৈধ লাইনে ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অপচয় হচ্ছে বিদ্যুতের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, মান্ডা, খিলগাঁও, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, মানিকদী, মোহাম্মদপুর, বছিলা, মধ্যবাড্ডা ও উত্তর বাড্ডা এলাকায় দেদারছে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। গলির ভেতরে এসব রিকশা চললেও সুযোগ বুঝেই গলি থেকে বের হয়ে মহাসড়কে উঠে যাচ্ছে।

সোমবার (১ আগস্ট) উত্তর বাড্ডা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সুমন নামে এক কিশোর ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক যাত্রী ডাকাডাকি করছে। বয়স জানতে চাইলে ১২ নাকি ১৪, ঠিকঠাক বলতে পারে না। তবে রিকশা পার্কিং আর ডাকাডাকিতে অন্যান্য রিকশাচালকের চেয়ে কোনো অংশেই কম যায় না।

জানতে চাইলে সুমন জানায়, রিকশাটি তার বাবার হলেও বেশিরভাগ সময় সে নিজেই চালায়। সাঁতারকুল এলাকায় একটি প্যাডেলচালিত রিকশা গ্যারেজ আছে। সেখানেই পার্কিংয়ের পাশাপাশি রাতে ব্যাটারি চার্জ দেয়। এক রাতে দুটি ব্যাটারি চার্জ দিতে ১২০ টাকা গুনতে হয়।

মগবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি রিকশার গ্যারেজ রয়েছে ওই এলাকায়। হাতিরঝিলের রাস্তা ঘেঁষে মগবাজারের একটি গ্যারেজে গিয়ে দেখা যায়, মূলত প্যাডেলচালিত রিকশার গ্যারেজে লাইট জ্বালানোর জন্য বিদ্যুতের লাইন নিয়েছেন তারা। কিন্তু একই গ্যারেজে লাইটের লাইন থেকে বাড়তি লাইন নিয়ে চার্জ দেওয়া হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।

এর আগে ২০২১ সালের মাঝামাঝি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। হাইকোর্টের পক্ষ থেকেও বন্ধের নির্দেশনা আসে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী দাবি করে বন্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায় বেশ কিছু সংগঠন। আবার ইজিবাইকসহ ব্যাটারিচালিত যানবাহন মহাসড়ক ব্যতীত সর্বত্র চলাচলের অনুমতি দিয়ে রায় দেন সুপ্রিম কোর্ট।

বিদ্যুতের এই সংকটের মুহূর্তে আবারও আলোচনায় আসে ব্যাটারিচালিত রিকশা। তবে বরাবরের মতোই ব্যাটারিচালিত রিকশাকে সাশ্রয়ী দাবি বিভিন্ন সংগঠনের।

রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা কতো তার সঠিক হিসাব নেই। তবে ১২ লাখের মতো রিকশা আছে- এ রকম একটা ধারণা বিভিন্ন জরিপে বলা হয়। রিকশার সংখ্যা বের করতে আমরা জরিপ করবো।

তিনি বলেন, একটা রিকশা রাতে চার্জ দিলে সারাদিন চলে। এতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, একটি এসি এক ঘণ্টা চালাতে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে। অথচ সরকার এসি বন্ধ রাখা নিশ্চিত করতে না পারলেও গরিব-অসহায়দের বাহন বন্ধ করছে। বড় বড় ভবনে যেসব এসি চলে, তার উপকারভোগী শুধু ধনীরাই। এসব রিকশায় আপামর জনতা উপকৃত হচ্ছেন। অন্তত এদিক বিবেচনা করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু রাখা উচিত।

সরকারকে যথেষ্ট বিল দিয়েই ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেওয়া হয় দাবি করে তিনি বলেন, একটা রিকশা চার্জ দিতে দেড় ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। যেসব জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেওয়া হয়, তারা বাণিজ্যিক মিটার বসিয়েই চার্জ দেয়। এতে তো সরকারের কোনো লস হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ভবনের হলরুমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট সভায় মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আজ প্রতিটি রাস্তা-মহল্লা অটোরিকশায় সয়লাব। একেকটা অটোরিকশায় চারটি করে ব্যাটারি থাকে। সারাদিন চালানোর পর এগুলো সারারাত চার্জে রাখা হয়। এসব অটোরিকশা বিদ্যুৎবিধ্বংসী। এতে প্রচুর বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি এগুলোতে প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটছে। শহরে আগে প্রচুর পায়েচালিত রিকশা চলতো। এখনো চলে। আমরা তো পায়েচালিত রিকশা বন্ধ করে দিচ্ছি না। যিনি অটোরিকশা চালাতেন, তিনি পায়েচালিত রিকশা চালাবেন। ডিএনসিসি এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের সাবেক ডিন ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা দরকার। এলাকা বুঝে গ্রামাঞ্চলে তিনচাকার ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রিকশার মতোই দেখতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা উচিত।

‘যদিও তারা রাতে চার্জ দেন। কিন্তু উৎপাদনের ভাগিদার তো তারা হচ্ছেন। এখন যেহেতু সংকটকাল, সবারই বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এই মুহূর্তে একজনকে দিতে গিয়ে আরেকজনকে কম দিলে চলবে না। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ বাদ দিতে হবে’ যোগ করেন তিনি।

রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এসব বন্ধ করা সম্ভব হয় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত যেসব গাড়ি আছে, আমি এসবেরও পূর্ণ সমর্থন করি না। যদিও এসব পরিবেশবান্ধব বলে অনেকেই বন্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। এটাও যেমন সত্য, আবার বিদ্যুতের ক্রাইসিস মুহূর্তে এগুলো বন্ধ রাখাও উচিত। অনুমোদন দেবে নাকি অবৈধ ঘোষণা করবে, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যদি এসব নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকতো, তবে এত বিস্তার ঘটতো না।

বৈশ্বিক সংকটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রাত ৮টার পর সারাদেশে দোকান, বিপণি-বিতান, মার্কেট ও কাঁচাবাজার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অফিসে এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া, সভা ভার্চুয়ালি করা, অফিস সময় কমানোর পরিকল্পনা, এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, আলোকসজ্জায় নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।