বেনজীরের সম্পদ জব্দের আদেশ কার্যকরে দুদক

সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের (ফ্রিজ) যে আদেশ দিয়েছেন আদালত, তা কার্যকরে প্রক্রিয়া শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আদালতের আদেশটি এখন গেজেট আকারে প্রকাশ করে তা নিজ খরচে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করতে হবে কমিশনকে। কমিশন চাইলে জব্দ ও অবরুদ্ধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ দিতে পারে। তবে অবশ্যই তা আদালতের আদেশের মাধ্যমে হতে হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর।

ঢাকা মহানগর আদালতের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গত বৃহস্পতিবার বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে ৮৩টি দলিলের স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেন।

আদালতের আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৮৩টি দলিলে জমি প্রায় ১১৪ একর। এর মধ্যে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে অন্তত ৮১ একর। বেনজীরের নিজের নামে রয়েছে ৭.৬০ একর।

বাকি প্রায় ২৬ একর জমি তাঁর তিন মেয়ে ও কয়েকজন স্বজনের নামে রয়েছে। তবে ৩৩টি ব্যাংক হিসাবে কত টাকা জমা আছে, সে হিসাব আদালতের আদেশ থেকে পাওয়া যায়নি।

দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার প্রয়োজন থেকেই তা করা হয়েছে। অনুসন্ধানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে কমিশন মামলা করবে।

মামলার বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তখন এই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। বাজেয়াপ্ত করার সময় যাতে কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয় সে জন্যই জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এখন এই স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে কিছুর করার থাকলে তা আদালতের আদেশের মাধ্যমে করতে হবে।’

অনুসন্ধানের পর যদি মামলা করা হয় তবে জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত বহাল থাকবে। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা না মিললে কমিশনই সম্পদ অবমুক্তির জন্য আবেদন করবে বলে জানান এই পাবলিক প্রসিকিউটর।

আদেশ কার্যকরের প্রক্রিয়া জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘আদালতের আদেশটি এখন গেজেট আকারে প্রকাশ করবে কমিশন। এরপর দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রচার করবে। এ দুটি প্রক্রিয়া ১৫ বা ৩০ দিনের মধ্যে করার বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে।’

আদালতের আদেশটি এরই মধ্যে কমিশনে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আরো বলেন, ‘কমিশন যদি মনে করে জব্দকৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রিসিভার নিয়োগ করা দরকার, তবে আদালতে আবেদন করে কমিশনকে রিসিভার নিয়োগ দিতে হবে।’

‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। এরপর গত ২ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে দ্বিতীয় দফার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এতে কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল আইনি নোটিশ দেন তিনি। নোটিশে স্বউদ্যোগে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয় কমিশনের চেয়ারম্যানকে। তাতে সাড়া না পেয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটে বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়।

গত ২৩ এপ্রিল এই রিট শুনানিতে ওঠে। শুনানিতে দুদকের আইনজীবী জানান, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে। পরে হাইকোর্ট অনুসন্ধান কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলে আদেশ দেন।

এ অবস্থায় গত ২৩ মে বেনজীর আহমেদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের নির্দেশনা চেয়ে সংস্থাটির অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. হাফিজুল ইসলাম আবেদন করলে আদালত সেই আদেশ দেন।

আদালত আদেশে বলেন, ‘বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পত্তি অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না। অতএব অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এ ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন, বিধিমালা-২০০৭-এর ১৮ বিধি অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হলো।’

আদেশে আরো বলা হয়, স্থাবর সম্পদের ওপর জব্দের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় কোনো অবস্থাতেই তা হস্তান্তর বা বিনিময় করা যাবে না। আর অস্থাবর সম্পদে অবরুদ্ধের আদেশ কার্যকর থাকা অবস্থায় ব্যাংক হিসাবগুলোতে অর্থ জমা করা যাবে, কিন্তু উত্তোলন করা যাবে না। আদেশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রচারের নির্দেশ দেন আদালত। এ জন্য আদেশের অনুলিপি কমিশনের সচিবের কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া আদেশের অনুলিপি কমিশনের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক, বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিসের উপপরিচালক, ঢাকা, গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, টেকনাফ, উখিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি), সাবরেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়।