ভবদহে প্রতিমাসে ৪ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ অপচয়

পাউবো’র (পানি উন্নয়ন বোর্ড) নেয়া ভবদহে পানি অপসারণের নামে মাসে প্রায় ৪ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কেবল পানিতে যাচ্ছে। যশোর-খুলনার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র প্রবাহ পথ ভবদহ স্লুইসগেট। মণিরামপুর, অভয়নগর, ফুলতলা এবং কেশবপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী স্থানে এটির অবস্থান। প্রতি মাসে এটি দিয়ে বিপুল ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যয়ে সেচ পাম্পে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম এ অঞ্চল প্রভাবিত এলাকায় সুফল বয়ে আনেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- দেশের চলমান জ্বালানি সংকটে এ প্রকল্পে যে বিদ্যুত ব্যয় হচ্ছে তা অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।

তারপরও পাউবো’র সেচ পাম্পের কর্মতৎপরতা থেমে নেই। বিএডিসি ও পাউবো যৌথভাবে সেচ কার্যক্রম চালালেও এখন পাউবো একাই কাজটি করতে যাচ্ছে। এজন্য এ বছর সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি পাম্প ঠিকাদারের মাধ্যমে কেনা হয়েছে এবং আরো ৩৫ টি পাম্প, ড্রেজার মেশিন কিনতে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে পানি সম্পাদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যা পরিকল্পনা মন্ত্রলয়ের ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানাগেছে।

ভবদহ এলাকায় ফসল ফলাতে এবং পানিবন্দী মানুষের দূর্ভোগ লাঘবে এ উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উপরোন্তু বিল থেকে পানি না সরায় গেলো বছরের তুলনায় এবার ধানের আবাদ আরো কমেছে। আর সেচ পাম্প দিয়ে ভবদহ স্লুইচগেট দিয়ে পানি নিষ্কাশনে লিকেজ (পানি নদীতে ফিরে আসা) হওয়ায় শুধু চোখে মিলছে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে কিন্তু। বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে এলাকাবাসী দাবি করেছেন। যে বিদ্যুত খরচ করে সেচ পাম্পে কার্যক্রমের মতো অনুন্নয়ন এ খাতে যে বিদ্যুত ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে বছরে ১৭ হাজার ৯টি পরিবারে (নিন্ম মধ্যে বিত্ত) বিদ্যুত ব্যয় সংকুলান হওয়া সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়- গেলো বছরের শুরতে ভবদহ এলাকায় কৃষি বিপ্লব ঘটাতে গৃহীত এ সেচ পাম্প কার্যক্রম আদৌ ভূমিকা রাখতে পারেনি। গেলো বোরো মৌসুমে গতবারের তুলনায় কম জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস সূত্রে জানাগেছে। তারপরও ভবদহ বিল পাড়ের জনমত উপেক্ষা করে বিপুল ইউনিট বিদ্যুত ব্যয় করে পাউবো সেচ পাম্প কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ভবদহের করাল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্থ বিল পাড়ের মানুষের সাথে কথা বলে এসব চিত্র উঠে এসেছে। ভবদহ এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের দাবি এসব অকার্য্যকর প্রকল্প বাতিল করে অবিলম্বে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ার-আধার) চালু করা গেলেই বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সম্ভবনা কথা ভাবছেন।

বিল কপালিয়ায় ফসল ফলাতে ২০২০ সালে মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়া গ্রামবাসি নিজ উদ্যোগে (নিজেদের সংগৃহীত টাকা) সেচ পাম্প কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর পাউবো এই ধারণা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিএডিসি’র (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) কাছে সেচ পাম্প কার্যক্রম গ্রহণের জন্য আবেদন করে। বিএডিসি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে পানি নিষ্কাশনে ৩০ এইসপি’র (হর্সপাওয়ার) ২০ টি পাম্প সরবরাহ করে।

পাউবো সুত্রে জানা গেছে- ভবদহ এলাকায় ফসল ফলাতে এবং পানিবন্দী মানুষের দূর্ভোগ লাঘোবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। সেচ কার্যক্রমের শুরুতে শুধু বিদ্যুত সংযোগসহ লজেস্টিক সাপোর্টে প্রায় সাড়ে তিনকোটি টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া প্রতি মাসে কয়েকলাখ টাকা বিদ্যুত বিল খরচসহ ব্যবস্থাপনা ব্যয়তো রয়েছেই।

যশোর পল্লী বিদ্যুত সমিতির-২ তৎকালীন ডিজিএম (কারিগরি) আবু হেনা শফিক কামাল জানান- পাউবো’র আবেদনের প্রেক্ষিতে সেচ পাম্প কার্যক্রম চালাতে ২০ টি সংযোগ দেয়া হয়েছিলো। পাম্প চালাতে ৭০০ কেভিএ ট্রান্সফরমার বসানো হয় সেখানে। যার কনস্ট্রাকশন ব্যয় হয় ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ট্রান্সফরমারের জন্য ব্যয় হয় প্রায় ২৫ লাখ টাকা। বছরে বিদ্যুত বিল পরিশোধ করে প্রায় দুই কোটি টাকা পড়ে।

সংশ্লিষ্টদের হিসাব মতে- ভবদহ সেচ পাম্প প্রকল্পে চলতি বছরের শুধু জুন মাসে ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হয়েছে। যা বছরে গড়ে ৪২ লাখ ৫৭ হাজার ২৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুত ব্যয় হয়েছে। যার ব্যয় ১ কোটি ৭০ লাখ ২৮ হাজার ৯৬০ টাকা।

অথচ বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশ প্রকোট জ্বালানি সংকটে নিমজ্জিত অবস্থা চলছে। এ কারণে বিদ্যুতের ব্যয় কমাতে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করছে। সংকট উত্তোরনে দেশেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বিদ্যুত সংশ্লিষ্টদের মতে দেশের একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে (যে পরিবারে ১টি ফ্রিজ, ১টি এসি, টিভি আছে) এমন পরিবারে প্রতিমাসে গড়ে ১২৫ কিলোওয়াট বিদ্যুত খরচ হয়। এ হিসেবে ভবদহে যে পরিমান বিদ্যুত ব্যয় হচ্ছে তা দিয়ে বছরে অনায়াশে প্রায় ১৭ হাজার ৯টি পরিবারে বিদ্যুত ব্যয় সংকুলান হওয়া সম্ভব।

পাউবো সূত্রে জানা যায়- ভবদহ তৎসংলগ্ন বিলে ফসল ফলাতে ও পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড) ও বিএডিসি (বাংলাদেশ কষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) যৌথ উদ্যোগে চলতি বছরের শুরুতেই এ কার্যক্রম শুরু করে।

বিএডিসির খুলনা বিভাগীয় প্রধান (সেচ বিভাগ) আব্দুল্লাহ আল রশিদ জানান- এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ কমাতে পাউবোকে বিএডিসি ৩০ এইচপি (হর্সপাওয়ার) পাওয়ারের ২০টি পাম্প সরবরাহ করে। যা রক্ষণাবেক্ষণে বিএডিসির ৮ জন লেবারসহ একজন উপ-প্রকৌশলী সেখানে সার্বক্ষনিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু লিকেজের দৃষ্টিগোচর হলে তা পাউবোকে অবহিত করা হলেও তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি সেখানে। ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিএডিসি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার, কৃষি সচিব (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত) মেজবাহুল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শনে আসলে একই বিষয়টি দৃষ্টি গোচর হয়। একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর যশোর সার্কিট হাউজে কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতে এক সভায় পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীকে দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও এখনও সেই লিকেজের বিষয়টি রয়েই গেছে।

ফসল ফলাতে ও পানিবন্দী মানুষের জন্য এ কার্যক্রম গ্রহন করা হলেও কোন সুফল বয়ে আনেনি বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন। হাটগাছা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পরমানন্দ মন্ডল, বিবেক মন্ডল, উৎপল বিশ্বাসসহ একাধিক ভুক্তভোগি জানান- আকাশ বৃষ্টি না থাকায় পানি কমলেও ফসল আরো কমেছে।

মণিরামপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবুল হাসান জানান- ভবদহের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে (কুলটিয়া, হরিদাসকাঠি, নেহালপুর, মনোহরপুর, খানপুর ও দূর্বাডাঙ্গা) ২০২০-২১ বোরো মৌসুমে ৮ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়। কিন্তু ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ কমে গিয়ে দাড়ায় ৭ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে। অনুরুপভাবে পাশ্ববর্তী অভয়নগর উপজেলাতেও আবাদ কমেছে।

অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা গোলাম সামদানি জানান- ভবদহের কারণে উপজেলার ৫ টি ইউনিয়নে (প্রেমবাগ, সুন্দলী, চলিশিয়া, পায়রা ও নওয়াপাড়া পৌরসভা) ২০২০-২১ বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ হয় ৬ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে এবং ২০২১-২২ বোরো মৌসুমে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৪৯ হেক্টর জমিদে। একইভাবে আমন ধানের আবাদও কমেছে। তিনি বলেন- পাউবো’র সেচ কার্যক্রমে আবাদযোগ্য জমির দৃশ্যত কোন অগ্রগতি হয়নি।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক রনজিত বাওয়ালী বলেন- ভবদহের এ সমস্যাকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদেরকে দায়ী করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে জিম্মি করে তারা ভবদহের সমস্যা সমাধানের নামে বড় বড় প্রকল্প তৈরি করে লুটপাট করে চলেছেন। যে কারণে যুগের পর যুগ ভবদহ পাড়ের মানুষের চোখের পানি পড়লেও ভবদহের মূল সমস্যার সমাধান আদৌ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সেচ প্রকল্পের নামে প্রকল্প তৈরি করে পানি অপসারণের কাজ চালিয়েছেন। অপরদিকে, লিকেজ দিয়েই আবার সেই পানি প্রবেশ করানো হচ্ছে। এতে বিদ্যুত ও অর্থের অপচয় ছাড়া জনগণের কোন উপকারে আসছে না।

জেলা পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন- সেচ পাম্প দিয়ে পানি অপসারনের কার্যক্রম দ্রুত সুফল আসবে না। উপকারভোগিদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। এজন্য পাউবো নিজস্ব উদ্যোগে ইতোমধ্যে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি পাম্প ক্রয়সহ আরো ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৫ টি পাম্প ক্রয়ের কার্যক্রম পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়য়াধীন রয়েছে।