ভাষার জন্য লড়াই : বাংলা লুকিয়ে পড়তেন মুসলিম মেয়েরা

ঢাকার ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে’ যে দিন প্রথম গিয়েছিলাম সেবার বেশ বড় একটা সাদাকালো ছবির সামনে পা আটকে গিয়েছিল। ছবিটা ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বেশ কিছু শাড়ি-পড়া মেয়েদের মিছিলের। ভাষা আন্দোলনে কবি সুফিয়া কামালসহ আরও কিছু মহিলার অংশগ্রহণের কথা ভাসাভাসা জানতাম। ছবিটা আমাকে বিরাট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। দেশভাগের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এত জন মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান নারী ঢাকার রাজপথে একটা রাজনৈতিক দাবিতে হাঁটছেন! কীভাবে সম্ভব হলো এটা?

উত্তাল চল্লিশের দশক নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি অবিভক্ত বাংলায় সে সময়কার আন্দোলনগুলোতে সমাজের নানা স্তরের হিন্দু মেয়েরা অনেক বেশি করে বেরিয়ে এলেও, বাঙালি মুসলিম ভদ্র নারীদের প্রায় দেখা যায়নি। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই তখন আগের দশকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি উচ্চ শিক্ষা ও চাকরিতে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন। জনপরিসরে এদের অনুপস্থিতির জন্য ধর্মভিত্তিক দেশভাগের আগে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী ছিল অনেকটাই।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ক্যামেরাবন্দি ওই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়েছিল সীমান্তের এপারে দেশভাগের আশপাশের বছরগুলোতে উদ্বাস্তু মেয়েদের বেঁচে থাকার বহুমাত্রিক লড়াই নিয়ে আমরা গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে যতটা জানার চেষ্টা করেছি, তার কণামাত্র কৌতূহল বোধহয় আমরা দেখাইনি একই মাতৃভাষার সম্মান আদায়ের জন্য ও-পারে যে মেয়েরা সমসময়ে পথে নামলেন, তাদের নিয়ে।

বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত মানুষজন বেশির ভাগই ১৯৪৮-৪৯’এ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের মধ্যে অনেকেই পড়তে পড়তে বা সদ্য পাশ করে ও-পারে গিয়ে নতুন করে পড়াশোনা বা চাকরিবাকরি শুরু করেন। পূর্ব বাংলার স্কুল-কলেজ ছেড়ে হিন্দু মেয়েরা অধিকাংশ এপারে চলে আসার পরে সেই জায়গায় মুসলমান মেয়েরা আগের চেয়ে ভর্তি হতে লাগলেন ঢের বেশি। ’৪৮-এ শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় না হলেও, মোটামুটিভাবে ’৫১ থেকে একটানা ’৫৬ পর্যন্ত চলা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া উর্দুর বদলে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ ও ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’ দাবিতে প্রায় সব জেলায় মেয়েরা সোচ্চার ছিলেন।

সে সময়ে স্কুলের মেয়েদের সংগঠিত করেছেন কলেজের ছাত্রীরা; অল্পবয়সিদের সঙ্গে তাদের মা-মাসিরা চাঁদা তুলে, লিফলেট বিলি করে, অভুক্ত ও অসুস্থ আন্দোলনকারীদের জন্য খাবার ও ওষুধের জোগান দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রীরা আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ১৪৪ ধারার নির্দেশ ভেঙে আগুয়ান হয়ে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠির আঘাত সয়েছেন; গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেছেন অনেকেই।

যে সময়ে সহপাঠী ছেলেদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা নিষিদ্ধ ও নিয়ম ভাঙলে দশ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা ছিল, সে যুগে পোস্টার লেখা থেকে শহিদ বেদি গড়া, সবেতেই শামিল ছিলেন এরা। হোস্টেল থেকে বার করে দেওয়া হতে পারে ছাত্রীদের, বাবা-মা পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারেন যে কোনো মুহূর্তে- এ সামাজিক বাধাগুলো তারা তুচ্ছ করেছিলেন। স্বাবলম্বী মহিলাদের কাউকে কাউকে বড় রকমের মাশুল দিতে হয়েছিল এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বার জন্যে।

নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের স্বামী তাকে তালাক দেন। কারণ, স্থানীয় আন্দোলনের এ নেত্রীকে কারাবন্দি অবস্থায় মুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছিল মুচলেকার বিনিময়ে। কিন্তু মমতাজ তাতে রাজি হননি।

এত ঝুঁকি নিয়ে কেন মেয়েরা ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন? ’৫২-য় স্কুলছাত্রী রওশন আহমেদ দোলনের যুক্তি ছিল, ‘তখন আমাদের ক্লাসে উর্দু পড়তে হতো, আর বাড়িতে কেউ উর্দু জানতেন না। কাজেই পড়া তৈরি করতে খুবই কষ্ট হত। আর নিজের ভাষা ছেড়ে আর এক জনের ভাষা আপন করে নেব, তা কিছুতেই হতে পারে না।’

মাতৃভাষার অধিকারের সঙ্গে আত্মসম্মানের প্রশ্নটা এক করে যারা দেখেছেন সেই ‘ভাষাকন্যা’দের স্মৃতিচারণগুলো পড়তে পড়তে আমার বার বার মনে হয় তাদের পুরোধা সুফিয়া কামালের কৈশোর-যৌবনে গোপনে মাতৃভাষায় লেখনীচর্চার কথা, আর সেই সূত্রে অবধারিত ভাবে সুফিয়ার পূর্বসূরি বেগম রোকেয়ার কথা।

১৯২০-এর দশকের শুরুতেও আশরাফ বা সম্ভ্রান্ত পাঠান/মোগল বংশোদ্ভূত সুফিয়াকে লুকিয়ে বাংলা পড়তে হতো, কারণ বাংলায় লেখাপড়া ছিল তার পরিবারের পক্ষে খুবই বেইজ্জতির ব্যাপার। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা উর্দু না বাংলা, এ প্রশ্ন তখন বড় করে দেখা দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ চাইছিলেন মাতৃভাষা বাংলার মধ্য দিয়ে ভাষিক জাতীয়তাবোধ ও রসগ্রাহী সাহিত্য সৃষ্টি হোক এবং সেই উদ্দেশ্যে দু’একটি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য গোষ্ঠী ও পত্রিকার উদ্ভব হয়।

অন্যদিকে সুফিয়ার পরিবারের মতো অনেকেই তখনও মনে করতেন, বাংলা হিন্দুদের ভাষা ও উর্দুর বদলে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার মান্যতা দিলে ইসলামি আনুগত্যের অভাব ঘটবে। এই সব পরিবারে ছেলেদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পাঠানো শুরু হলেও পরিবার ও সমাজের সম্মান ও মূল্যবোধ রক্ষার্থে মেয়েদের কোনো অধিকার ছিল না অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যেও বাংলা পড়ার। বরিশালের একটি বাংলা পত্রিকায় সুফিয়ার প্রথম লেখা বেরোনোর পর তাকে বহু গঞ্জনা সহ্য করতে হয়।

সুফিয়া ও তার পরবর্তী প্রজন্মের মেয়েরা যে ’৫০-এর দশকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষ নিয়েছিলেন, আমাদের মনে রাখা দরকার যে তার জন্য যার অবদান সর্বাধিক, তিনি হলেন রোকেয়া। আমরা তাকে একজন কালোত্তীর্ণা লেখিকা, সমাজসংস্কারক এবং নারীশিক্ষার পথিকৃৎ বলে জানি। কিন্তু যেটা আমরা সচরাচর স্মরণ করি না, সেটা হলো শিক্ষায়তনে বাঙালি মুসলমান মেয়েদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার প্রায় তার একার সংগ্রামে অর্জিত হয়েছিল। বিশ শতকের তৃতীয় দশকেও তিনি তার লেখায় আক্ষেপ করেছেন যে বাঙালি মুসলমান মাতৃহীন কারণ তার কোনো মাতৃভাষা নেই।

রোকেয়া নিজে বাংলা শিখেছিলেন তার বোন করিমুন্নিসার কাছে সংগোপনে। ১৯১১-য় রোকেয়ার নিজের স্কুল সাখাওয়াত মেমোরিয়ালের গোড়াপত্তনের সময় থেকে তিনি অবরোধবাসিনীদের শিক্ষার জন্য প্রাণপাত করেছিলেন তো বটেই। তা ছাড়া বাঙালি মেয়েদের জন্য তার স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষা চালু করতে তাকে পাহাড়প্রমাণ বাধা ডিঙাতে হয়। প্রায় ষোলো বছরের চেষ্টায় ১৯২৭ সালে তিনি উর্দু মাধ্যমের পাশাপাশি বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা পুরোপুরি চালু করতে সক্ষম হন, এবং এর পরের দু’দশকে ছাত্রীদের মধ্যে ভাষিক জাতীয়তাবোধ চারিয়ে দিতে এ স্কুলটি বিরাট ভূমিকা নেয়। ভাষাদিবস তাই তাকে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত বলে দাবি করবার প্রকৃষ্ট সময়।

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত গবেষক, লেখক ও নারীবাদী আন্দোলনের কর্মী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্তের কলাম।