ভ্যাকসিন ডিপ্লোম্যাসি: দুই দেশের টিকাই পাবে বাংলাদেশ

ভারতের জোর আগ্রহ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য চীনকেই বেছে নিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের যুক্তি, আগে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে, তাই তাদের ট্রায়াল দেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।

কূটনীতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনকে আগে দেয়া হয়েছে, তার মানে এ নয় ভারতকে দেয়া হবে না। ভারত যখনই প্রস্তাব দেবে, তখনি তাদের ট্রায়ালের সুযোগ দেবে বাংলাদেশ। আর এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের কাছ থেকেই ভ্যাকসিন পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা।

তবে চীনকে অনুমতি দেয়ার বিষয়টি এতটা সহজ ছিল না বলে মনে করছেন কূটনীতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটা কূটনৈতিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই ভারতের পরিবর্তে চীনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

বৃহস্পতিবার তার ঘোষণায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাককে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে সরকার। আইসিডিডিআরবি’র সহযোগিতায় এ ট্রায়াল হবে। এর বাইরেও ভ্যাকসিন নিয়ে যেসব দেশ কাজ করছে তাদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। চীন যেহেতু সবার আগে প্রস্তাব দিয়েছে তাই তাদের সবার আগে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। চীনের এ কোম্পানি যখনই কাজ শুরু করবে, আমরা তখনই ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত।

ভারত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে ভ্যাকসিন আগে আসবে সেটাই আমরা আগে নেব। স্বেচ্ছাসেবক যত পাওয়া যাবে তার ওপর সংখ্যা নির্ধারিত হবে। ভারত অনুমতি চাইলে তাদেরও ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হবে।
অথচ বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল দিতে চীন আগ্রহ দেখিয়েছিল প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় আগে। চীন চেয়েছিল আইসিডিডিআর’বির মাধ্যমে তারা ট্রায়াল দেবে। এজন্য গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল –বিএমআরসির অনুমতিও নিয়েছিল তারা। কিন্তু এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছিল না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ছিল এক ধরনের লুকোচুরি।

প্রথমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে দায় চাপায়। তারা বলে, দুই দেশের বিষয় হওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুমতি প্রয়োজন। পরে জানায়, চীনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। চীন দেশের সঙ্গে নয়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিডিডিআর’বির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আরও চাপ তৈরি হয় যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধণ শ্রিংলা হঠাৎ করে ঢাকা সফর করেন। কূটনৈতিক নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হলেও এ সফর নিয়ে প্রকাশ্যে দুপক্ষই জানিয়েছে, মূলত করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দিতেই শ্রিংলার ঢাকা সফর।

ভারত ও চীন, দুই পক্ষেরই ভ্যাকসিন নিয়ে প্রস্তাবের কারণে কূটনীতিকদের আগ্রহ ছিল, কোন পক্ষে যায় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত চীনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার বিষয়টি নিয়ে দারুণ কৌতূহল কূটনীতিক মহলে। সময় সংবাদকে তারা বলেন, এমনিতে গত কয়েকমাস ধরে বেশ কিছু ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে এক ধরনের শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে দীর্ঘদিনের মিত্র বাংলাদেশের। সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার মতো বিষয়ে দেশের ভিতরেই এক ধরনের চাপ আছে বাংলাদেশের সরকারের ওপর। বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা মনোক্ষুণ্ন সরকারের শীর্ষমহল। বিষয়গুলো টের পেয়েই করোনার মধ্যে প্রথমবারের মতো ভারতের কোনো কূটনীতিক দেশের বাইরে ঢাকা ছুটে আসেন বরফ গলাতে। কিন্তু চীনের আগ্রহে প্রথম সাড়া দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের পথে হাঁটছে বলে মনে করেন তারা।

যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন মনে করেন, ভারত ও চীন ইস্যুতে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ কেউ এটা রাজনৈতিক বিষয় বানানোর চেষ্টা করছেন। দিস ইস পিওরলি রিসার্চ। আমাদের দেশের মানুষের জন্য যদি এ ভ্যাকসিন ব্যবহার করতে হয় তাহলে সেটা নিয়ে সরকার চিন্তা করবে।

আলোচনায় আছে অন্য দেশের ভ্যাকসিন ট্রায়ালেরও। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ভারত ও পাকিস্তান যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে এটা করছে। যেখানে পাওয়া যায় তাদের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা চুক্তি করা উচিত। তাতে সস্তায় শিগগিরই আমরা ভ্যাকসিন পাব। আমরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে একটি উদ্যোগ নিয়েছি। যার মাধ্যমে যার যার দরকার তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন দেয়া যাবে বলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আমরা এটা করেছি। আমরা চাই এগুলো দ্রুত হোক।

ভারত বললে যে কোনো সময় তার ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ব্যবস্থা হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এটিকে আলাদা করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি বলে ভাবার উপায় নেই বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।

করোনা প্রতিরোধে জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটিও দেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের পক্ষে বলে মত দিয়েছে। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লার মনে করেন, বিশ্বের যেসব দেশ যেমন: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া ভ্যাকসিনের গবেষণায় এগিয়ে আছে। তারা তাদের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অন্যান্য দেশও অংশগ্রহণ করছে। যেমন: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল ব্রাজিল ও ভারতে হচ্ছে। চীনের সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ফিলিপিন ও তুরস্কে হচ্ছে। এখণ বাংলাদেশেও এ ভ্যাকসিন সফল প্রমাণিত হলে প্রথম পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

জাতীয় পরামর্শক কমিটি মনে করে, শুধু ট্রায়াল দিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। বাংলাদেশে কী পরিমাণ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন এবং তা সংগ্রহে কত খরচ হবে কিংবা বিনামূল্যে পাওয়া যাবে কি না এ ব্যাপারে এখনই হিসাব করা প্রয়োজন। ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন বা ক্রয় করার প্রস্তুতি থাকতে হবে। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির পরে এর সংরক্ষণ, বিতরণ, লোকবল, সরঞ্জামসহ সব পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এখনই ঠিক করে রাখা উচিত।

সাধারণত প্রথম ব্যবহারযোগ্য ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমেই বিতরণ করা হয়। একটি নির্দিষ্ট মাথাপিছু আয়ের নিচে থাকা দেশগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিনামূল্যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভ্যাকসিন দিয়ে থাকে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। দ্রুত ভ্যাকসিন পেতে হলে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা সে দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। প্রয়োজনে তাদের অগ্রিম অর্থ দিয়ে বুকিং করতে হয়। তবে বাংলাদেশ যেহেতু ট্রায়ালের সুযোগ দিচ্ছে তাই অগ্রাধিকার পাবে।

এ ট্রায়ালটি হবে আইসিডিডিআর’বির তত্ত্বাবধানে। দেশের ৭টি হাসপাতাল থেকে স্বেচ্ছায় ৪ হাজার ২শ’ স্বাস্থ্যকর্মী বাছাই করা হবে। এ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে থাকবেন ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ড বয়রা। এছাড়া চীনা দূতাবাস এবং বাংলাদেশে কর্মরত চীনের নাগরিকদের কেউ আগ্রহী হলে তাদেরও সুযোগ দেয়া হবে। তাদের দুভাগে ভাগ করে টিকা দেয়া হবে। একভাগে চীনের টিকা এবং অন্যভাগে সাধারণ টিকা দিয়ে দুটি অংশকেই গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কোনো অংশের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে সেটি পরীক্ষা করে ঠিক করা হবে ট্রায়ালের চূড়ান্ত ফলাফল। এজন্য চীন থেকে ১ লাখ ভ্যাকসিন দেয়া হবে। ট্রায়ালের সব খরচও বহন করবে দেশটি। খবর সময়টিভি’র।