মহররমের দিকনির্দেশনা ও আশুরার তাৎপর্য

হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম। মহররাম হলো, সম্মানিত চারটি মাসের অন্যতম। রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম এই চারটি মাস আল্লাহর কাছে সম্মানিত। এ মাসের মর্যাদা ঘোষণার পাশাপাশি করণীয় কী হবে- সে দিকনির্দেশনা এসেছে কুরআনে পাকে। তাহলে মহররমর মর্যাদার সঙ্গে পালনীয় সেই দিকনির্দেশনা কী?

হিজরি চন্দ্রবর্ষের দিন-তারিখগুলোর হিসাব রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসলামের বিধি-বিধান, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক বিভিন্ন দিবস ও মাহাত্ম্যপূর্ণ রাতগুলো হিজরি চন্দ্রমাসের তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। যেহেতু হিজরি সনের প্রথম মাস মহররাম। আল্লাহ তাআলা এই মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অবিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কুরআনুল কারিমে মহররমসহ সম্মানিত ৪ মাসের দিকনির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে ‍তুলে ধরে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَات وَالأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلاَ تَظْلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ وَقَاتِلُواْ الْمُشْرِكِينَ كَآفَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَآفَّةً وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ
আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর (হারাম বা সম্মানিত ৪ মাসের) মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সঙ্গে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৩৬)

কুরআনুল কারিমে এ আয়াতে উল্লেখিত বারোটি মাসের মধ্যে চারটি সন্মানিত মাস- রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম (যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য) নিষিদ্ধ- তথা সম্মানিত। এটি ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিধান। এ হারাম মাসসমূহে কেউ কারো প্রতি জুলুম অত্যাচার করবে না। রক্তপাত ঘটাবে না।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে চারটি অতি সম্মানিত। তিনটি লাগাতার জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম আর চতুর্থটি হলো জুমাদাস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস রজব। (বুখারি)

মহররমের ১০ তারিখ আশুরার ঐতিহাসিক তাৎপর্য

মুসলমানদের কাছে অতিসম্মানিত মহররাম মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। মাসটি ইসলামের ইতিহাসে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে প্রসিদ্ধ। মহররম মাসের ১০ তারিখের দিনটিকে আশুরা বলা হয়। আশুরা, ‘আশিরুন’ এর বহুবচন। এর অর্থ- দশম তারিখের সমন্বয়।

মহররম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী মুসলিম উম্মাহর জন্য সঠিক পথ প্রাপ্তি, কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন, দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তির জন্য অনন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। এই দিনে হজরত মুসা আলাইহিস সালাম যেমন ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন; তেমনি দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখময় ঘটনা কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন ও তাঁর পরিবারবর্গের শাহাদাত এক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচিত হয়েছিল।

তৎকালীন শাসক ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক ফোরাত নদীর তীরে কারবালার কঙ্করময় মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলিজার টুকরা নাতি, হজরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার নয়নমণি হজরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন।

এভাবে আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে শুধু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাই জড়িত নয়; বরং এই দিনে ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই দিনে তাঁর কুদরতের বহু নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। হাদিসে পাকে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা এই দিনে বনি ইসরাঈলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।’ (বুখারি)

দ্বিতীয় হিজরির রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরায় রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে বছরের অন্য যেকোন দিনে নফল রোজার চেয়ে আশুরার দিনে নফল রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফযিলত অনেক বেশি। মহররাম মাস ও আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বুখারি)

২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মহররাম মাসের রোজা। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ।

৩. আশুরার রোজা সম্পর্কে হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত হয়েছে, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখলেন ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমরা তো তাদের অপেক্ষা হযরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসরণের অধিক যোগ্য। এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এদিনে রোজা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোজা রাখাতে বললেন। (বুখারি)

৪. ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা আশুরার দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রোজা রাখে। তাই রাসুলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মহররামের ১০ তারিখের রোজার সঙ্গে তার আগের দিন অথবা পরের দিন (৯ অথবা ১১ মহররাম) মিলিয়ে দুইটি রোজা রাখতে বলেছেন।

৫. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরার রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের সগিরাহ গোনাহসমুহ মাফ হয়ে যায়।’

৬. অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি উদার চিত্তে মুক্ত হস্তে আশুরার দিন দান-খয়রাত করবে, আল্লাহ তাআলা সারা বছর তার রুজি-রোজগারে বরকত দান করেন।’

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, মহররাম মাসের দিকনির্দেশনা মোতাবেক মহররমসহ সবসময় জুলুম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকা। আশুরার দিনের করণীয় মেনে রোজা পালন, দাস-সাদকা ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে হাদিসে ঘোষিত ফজিলত অর্জন করার চেষ্টা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহজকে মহররম ও আশুরায় বেশি বেশি দান-খয়রাত, তাওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা ও অন্যান্য নেক আমল করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।