মানুষকে ভালোবাসা শিখতে হবে || আবদুল হাই ইদ্রিছী

।আ।ব।দু।ল।। হা।ই।। ই।দ্রি।ছী।

কয়েক দিন থেকে শরীরের অবস্থা ভালো না। ডাক্তার বলেছেন প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু চোখের সামনে কাজের পাহাড়। বিশ্রামের সময় কোথায়? শরীরের সাথে যুদ্ধ করেই চলতে হচ্ছে, কিন্তু আজ (০৪ এপ্রিল ২০১৯) শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। মাথা তুলে দাঁড়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অফিসে যাবার সাহস করতে পারিনি। কিন্তু এর মধ্যে এলাকার একটি পারিবারিক শালিস- বিচারে না গিয়ে পারলাম না। ভাবলাম যেহেতু বাড়ির কাছেই আছে আর বিষয়টা জটিল এবং এই শালিসের বিষয়টা নির্ভর করছে একমাত্র আমার উপর, তাহলে একটু কষ্ট করে হলেও কিছু সময় দিয়ে আসি। কিন্তু গিয়ে পড়লাম মহা সমস্যায়। শেষও হচ্ছে না। উঠেও আসতে পারছি না। শরীরও মানছে না। তৃতীয় পক্ষ দুইজন থাকলেও একমাত্র আমাকেই বিচারকের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। কি আর করবো- শেষ পর্যন্ত শরীরের সাথে পুরো দমে জুলুম করে ১০.৩০টা থেকে ০৪.৩০টা পর্যন্ত বসতেই হলো। এই পুরো ৬ঘন্টা সময় আমাকে অনর্গল কথা বলতে হয়েছে। নাওয়া খাওয়া কিছুই হয়নি। এমনকি একটু চাও পান করিনি। আলহামদুলিল্লাহ্ শেষ পর্যন্ত বিষয়টা সমাধান হয়েছে। এর মধ্যে আমার জানা মতে কারো কোন পক্ষ নেবার চেষ্টা করিনি, নিজের অজান্তে যদি কোন ত্রুটি করে থাকি তাহলে আল্লাহ্পাকের দরবারে ক্ষমাপ্রার্থী।

এতো কষ্ট করে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বসলেও শেষ পর্যন্ত যখন দেখেছি উভয় পক্ষই নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছেন এবং সুন্দরভাবে সান্ত্বনা পেয়েছেন তখন খুবই ভালো লেগেছে। এতোই ভালো লেগেছে যে- কিছু সময়ের জন্য আমি পুরোদমে সুস্থ হয়েই গিয়েছিলাম।

এই ছোট্ট জীবনে ঢাক-ঢোল না পিটিয়ে এমন শালিস বিচার করেছি অনেক। আলহামদুলিল্লাহ্ প্রতিটিতেই সফল হয়েছি। সফলতার পেছনে যে কারণটা খুঁজে পেয়েছি তাহলো আল্লাহ্কে হাজির-নাজির জেনে স্বার্থহীনভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইনসাফের উপর অটল থেকেছি। প্রতিটি বিচার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। একেকটি থেকে এক এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। যা চলার পথে আমার খুবই কাজে আসে। এই শালিশ-বিচারের ক্ষেত্রে প্রথম যে বিষয় প্রয়োজন বলে আমি মনে করেছি তা বাদী এবং বিবাদীর কাছে গ্রহণযোগ্য বিচারকের প্রয়োজন। অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষ চেনার অভিজ্ঞতা।

আমি মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে থাকি। ১.গুণগত মানুষ। ২. জন্মগত মানুষ। গুণগত মানুষ হলো যারা মানবকুলে জন্ম নিয়ে মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করতে পেরেছে আর জন্মগত মানুষ হলো যারা শুধু মানবকুলেই জন্ম নিয়েই শেষ কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ বলতে তাদের কাছে কিছু নেই। এই গুণগত মানুষগুলোই সমাজের সম্পদ। এদের কারণে এখন পর্যন্ত সমাজ কিছুটা হলেও বসবাস যোগ্য আছে। এবং জন্মগত মানুষগুলো সমাজের কাল। তাদের কারণেই সমাজে সকল ধরনের অপকর্মের সৃষ্টি হয় আর এসব বিষ ফল ভক্ষণ করতে হয় গোটা জাতিকে।

সমাজের মুখোশধারী কিছু মানুষ আছে যাদেরকে মনোবিজ্ঞানের উপর পিএইচডি করেও চেনা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু এরা আমাদের মাঝেই বসবাস করে। আমাদের পাশে থাকে। আমাদেরই ভালোবাসা নিয়ে চলে। আমাদেরই আত্মার আত্মীয় হয়ে থাকে। আবার আমাদেরকেই সুযোগ বুঝে ছোবল মারে কিন্তু আমরা তাও বুঝতে ব্যর্থ হই। সর্বোপুরি সমাজে সবচাইতে কঠিন কাজ হলো মানুষ চেনা।

মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-বাচ্চা নিয়ে আমাদের পরিবার। এই পরিবারই আমাদের শান্তির প্রথম ঠিকানা। কেউ উচ্চ শিক্ষিত, চাকুবীজীবী, কোটিপতি হয়েও যদি সারা দিন এসির নীচে অফিস করে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে পরিবারে শান্তি না পান তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। আবার একজন দিনমজুর বা রিক্সাচালক যদি সারাদিন রোদে পুড়ে,বৃষ্টিতে ভিজে, কাজ কর্ম করে বেলা শেষে বাড়ি এসে শান্তিতে একটু ডাল ভাত খেয়ে মনে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে পারে তাহলে তার জীবনটা সার্থক।

পারিবারিক জীবন সুখকর করতে হলে প্রথমত পরিবারের কর্তা ব্যক্তিকে হতে হবে সততার দিক থেকে সচেতন। তার বিচারের পাল্লা সবার জন্য হতে হবে সমান। সকল সদস্যের মন-মানসিকতা হতে হবে সুন্দর। একের প্রতি অন্যে ভালোবাসা হতে হবে প্রাণবন্ত। কোন ক্ষেত্রে কারো ব্যতিক্রম হলে অন্যজন তা ধৈর্যের সাথে মেনে নেয়ার মানসিতকা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে পরিবারের সকল মানুষের বুঝ শক্তি সমান হয় না, তাই সকল সময় ক্ষমার মানসিকতাকে জাগ্রত রাখতে হবে। পৃথিবীতে সব চাইতে বড় প্রতিশোধ হলো ক্ষমা। আর সব চাইতে বড় শক্তি হলো সবর বা ধৈর্য। এদুটির ফলও খুব মজাদার। আলহামদুলিল্লাহ্ আমার ছোট্ট এবয়সে এদুটির ফল অনেক বার ভক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। মনে রাখবেন- মন যার পাষাণ, মানুষকে শুধু উপদেশ দিয়েই যে কর্তব্য শেষ করতে চায়, ভালোবাসায় অগ্রসর হতে কার্পণ্য করে, দুর্বল ও অপরাধীকে যে ক্ষমা করতে চায় না, সে মানুষ হিসাবে গণ্য হয় না। তার দ্বারা সমাজের অপকার ছাড়া কোন উপকার হতে পারে না।

মানুষ সমাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়েই থাকতে হয় আর এই সমাজকে সুন্দর করে সাজানোর দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাই সমাজকে সুন্দর করতে হলে সবার আগে মানুষকে ভালোবাসা শিখতে হবে। পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে বড় পাপ হলো মানুষের মনে কষ্ট দেয়া। সুতরাং এ মহাপাপ থেকে আমাদেরকে দূরে থাকার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। টাকার গর্বে, ক্ষমতার গর্বে, জনবলের গর্বে মানুষের মনে কষ্ট দেবার আগে একবার চিন্তা করা উচিত আমার এসব গর্ব কত দিন থাকবে? সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখা উচিৎ এমন গর্বধারী কত অহংকারী কিছু দিনের ব্যবধানে পথে নেমে মানুষের করুণার পাত্র হচ্ছেন, তাই এসব থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

দার্শনিক প্লুটার্ক বলেছেন- “যে বড় যুদ্ধে জয় লাভ করে, তার মনুষ্যত্ব সূচিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি রহস্য একটুখানি সহৃদয়তা, একটা স্নেহের বাক্যে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। যে মানুষ জীবনের এক একটা নিষ্ঠুর বাক্য, মানুষের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার, এবং প্রতারণা থেকে মুক্ত করে রাখতে পারবে জীবন শেষে সে দেখতে পারবে সে তার জীবনকে সার্থক করেছে।

প্রতিদিনকার জীবন যার নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা-তার সমস্ত জীবনটাই একটা ভাঙ্গা ঘরের মত অন্তঃসারশূন্য। প্রতঃকালে উঠেই প্রজ্ঞা কর, “আজিকার দিনটা সফল ও সার্থক করবো। আমার আজিকার এই দিনের কার্যে যেন মানব সমাজ উপকৃত হয়। যার সঙ্গে কথা বলি, তাকেই যেন আনন্দ দিতে পারি। যেন কোন কার্যে কাপুরুষ না হই। এর প্রতি মুহূর্ত আমার জীবনে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।”

প্রত্যেক মানুষের প্রধান কাজই হচ্ছে নিজের স্বাভাব-চরিত্রকে গঠন করা। ইহা অপেক্ষা মানুষের প্রতি আল্লাহর আর কোন বড় আদেশও নাই। তাই তিল তিল করে নিজের স্বাভাবকে গঠন করে তোলার চেষ্টা আমাদের প্রত্যেকের থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে কথায় চতুর ও তার্কিক হওয়া খুব সহজ হলেও নিজেকে গঠন করা খুব কঠিন। আমরা প্রত্যেকে এই কঠিক কাজটি করতে পারলে যেমন সফল হবে আমাদের জীবন তেমন সুন্দর ও শান্তিময় হবে আমাদের পরিবার ও সমাজ।

আবদুল হাই ইদ্রিছী : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার ও কবি। সম্পাদক: মাসিক শব্দচর।