মূলধন সংকটের সবটাই খেলাপির ২২ হাজার কোটি টাকা

একটানা দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ ব্যাংকিং খাতে মূলধন সংকট হওয়া অঙ্কের বেশি। বর্তমানে ব্যাংক খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন সংকট রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার (১৫ মার্চ) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সর্বশেষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। যা এ সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপিঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ ছিল।

ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বিগ্ন বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন গভর্নর ফজলে কবির। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি গুরুতর সমস্যা। এই বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্বিগ্ন। তবে হঠাৎ করেই দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি। এটা দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।

জানা গেছে, ২০১১ সালের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ।

ব্যাংক খাতে সুশাসন না থাকার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য তিনি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাকে দায়ি করেন।

অপরদিকে সরকারি সব ব্যাংকেই এখন মূলধন সংকট চলছে। এই সংকট মেটাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সরকারের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। রাষ্ট্রও বাধ্য হয়ে এই মূলধন যোগান দিতে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এই অর্থ না দিলে ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়বে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বিদেশে মর্যাদা সংকটে পড়বে। তাই দেশের মান রক্ষায় সোনালীসহ সব ব্যাংককে অর্থ দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শেষ সময়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেছে। এর ফলে হিসাবের খাতায় কিছুটা খেলাপি ঋণ কম দেখাচ্ছে। গত ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপিঋণ ছিল ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ হিসাবে গত তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপিঋণ কমেছে প্রায় ৬ হাজার ৪ কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো—ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো তাদের অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাই সেখানে ভালো অবস্থান দেখাতেই বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে থাকে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা নবায়ন। আর বছরের শেষ সময়ে এসে এই সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ে। এছাড়া বছরের শেষ সময়ে ঋণ আদায় কার্যক্রম জোরদার করা হয়।

এতে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ৭ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর ডিসেম্বর শেষে আলোচিত ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপিঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা; যা এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭৮ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত রাস্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি মালিকানার দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৩০ হাজার ৬২২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার ঋণের বিপরীতে খেলাপি হয়েছে ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ০৪ শতাংশ।

ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি হওয়া ঋণের পরিমাণের সম পরিমাণ অর্থ এখন ব্যাংক খাতে নেই। এই বিশাল পরিমাণ অর্থ সংকটের কারণে মূলধন সংকটে পড়তে হয়েছে। খেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকে ইচ্ছে করে খেলাপি হয়েছেন। যাতে পরবর্তিতে আর্থিক সুবিধা নিতে পারেন।

এজন্য বিশেষ তদন্ত করে এদের শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন তারা।