যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে কয়েকদিন

সোমবার অপরাহ্ন তথা নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত প্রায় ১০ কোটি আমেরিকান ভোট প্রদান করেছেন। প্রবাসীদের ৮০% আগাম ভোট দিয়েছেন বলে কমিউনিটি সূত্রে বলা হয়। করোনার আতংকে কেউ ভীড় ঠেলে মঙ্গলবার কেন্দ্রে যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ না করায় আগাম ভোট দেন তারা। আগাম ভোটের মধ্যে ৬ কোটি ২৫ লাখ ডাকযোগে এবং অবশিষ্ট ৩ কোটি ৭৫ লাখ আমেরিকান সশরীরে আগাম ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট স্ক্যান করেছেন।

সারা আমেরিকায় ভোটের গতি-প্রকৃতি নিয়ে কর্মরত দল-নিরপেক্ষ ওয়েবসাইট ‘ইউএস ইলেকশন্স প্রজেক্ট’র অধিকর্তা ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার অধ্যাপক মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড সোমবার রাতে এ তথ্য জানান।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের নির্বাচনে ১৩ কোটি ৯০ লাখ আমেরিকান ভোট দিয়েছিলেন। এবার সে সংখ্যা ছাড়িয়ে ১৬ কোটির কাছে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের আতংকে গণহারে আগাম ভোটের প্রবর্তণ করার পাশাপাশি ডাকযোগে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করার সুফল হিসেবে রেকর্ডসংখ্যক ভোটার এবারের নির্বাচনে অংশ নিলেন।

এর ফলে মঙ্গলবার রাত ১০টার মধ্যে ভোট গ্রহণের সময়সীমা অতিবাহিত হলেও ফলাফল জানতে অপেক্ষা করতে হবে বেশ কদিন। ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় লাগবে এ সময়।

নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেছেন, ৫০টির মধ্যে মাত্র ৯ স্টেটের ৯৮% রেজাল্ট বুধবার দুপুরের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। ওয়াশিংটন ডিসি এবং আরো ২২টি স্টেটের ব্যালট ডাকযোগে ৪ নভেম্বর বুধবার পর্যন্ত পাওয়া গেলেও সেগুলো গণনায় আসবে।

এজন্যে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষার সময় বাড়বে। নিউইয়র্ক এবং আলাস্কা স্টেট কখনোই ডাকযোগে আসা ব্যালটের গণনা নির্বাচনের দিন রাতে সম্পন্ন করতে পারে না। রোড আইল্যান্ডেরও একই অবস্থা।
দোদুল্যমান পেনসিলভেনিয়া এবং মিশিগান স্টেটের নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান যে, পূর্ণাঙ্গ ফলাফল জানতে কদিন অপেক্ষা করতে হবে।

উল্লেখ্য, ২৩ স্টেটের বিপুলসংখ্যক ভোটার ডাকযোগে ব্যালটের আবেদন করেছিলেন।

কিন্তু পরবর্তীতে তারা মত পাল্টিয়ে সশরীরে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব ভোটারকে প্রভিশনাল ব্যালট সংগ্রহ করতে হবে। আর এসব ব্যালট গণনায় তখনই আসবে, যদি প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যালট গণনার পর দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান খুব বেশি হয়। তেমন পরিস্থিতির অবতারণা হলে রেজাল্টের জন্যে অপেক্ষার সময় দীর্ঘতর হতে বাধ্য। কারণ, ডাকযোগে সংগ্রহ করা ব্যালটগুলো পোস্ট করা হয়েছে কিনা কিংবা তারা যে বিবরণ দিয়ে ব্যালট সংগ্রহ করেছেন তা সঠিক কিনা-বিস্তারিতভাবে তা খতিয়ে দেখবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আগাম ভোটে ডেমক্র্যাট বাইডেন এগিয়ে থাকলেও কেন্দ্রে এসে ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোট প্রদানকারির মধ্যে রিপাবলিকান ট্রাম্পের সমর্থক অনেক বেশি। এজন্যে ট্রাম্প চাচ্ছেন যে কোন উপায়ে নির্বাচনের দিনই ফলাফল ঘোষণা করাতে। এজন্যে রিপাবলিকানরা নানা কৌশলে এগুচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় কারচুপি এবং ভোট-জালিয়াতির আশংকা আগে থেকেই জোরালোভাবে করে আসছেন ট্রাম্প।

বিগত নির্বাচনগুলোর আলোকে আরিজোনা, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, নর্থ ক্যারলিনা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন-এই ৮ স্টেটকে বলা হয় স্যুয়িং স্টেট অর্থাৎ এসবের ভোটারের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করে। গত নির্বাচনে উইসকনসিন, মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়ায় জয় পেয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারের সর্বশেষ জরিপে গড়পরতা সমান অবস্থানে রয়েছেন বাইডেন ও ট্রাম্প। জর্জিয়া, পেনসিলভেনিয়া, মিশিগান, আরিজোনায় বাইডেন বিজয়ী হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বিরাটসংখ্যক ভোটার এবং কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারের সিংহভাগ বাইডেনকে ভোট দিচ্ছেন বলে বিভিন্ন অবজার্ভেশনে উঠে এসেছে। গত নির্বাচনে নারী হিসেবে এবং আরো কিছু কারণে হিলারিকে ভোট দেননি অনেক কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ ডেমক্র্যাট। তারা এবার বাইডেনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন আগে থেকেই। ফ্লোরিডায় বাইডেন এগিয়ে থাকলেও গতকদিনে সে ধারায় পরিবর্তন এসেছে।

কারণ, ট্রাম্প নিউইয়র্ক ছেড়ে ফ্লোরিডার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। এ দাবিতে তিনি ভোটারের হৃদয়ে ভিন্ন একটি স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন বলে সর্বশেষ জরিপে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ইলেক্টরাল ভোটে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবেন-তা নিশ্চিত করে কেউই এখন আর বলছেন না। তবে করোনাভাইরাস রোধে চরম ব্যর্থতার পরিচয় এবং লাগাতার মিথ্যাচার ও সত্যের অপলাপ করার জন্যে সচেতন আমেরিকানের অধিকাংশই আর ট্রাম্পের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না বলে প্রধান প্রধান জরিপে সোমবার রাতে বলা হয়েছে।

মুসলিম কমিউনিটি এবং হিসপ্যানিকদের যে অংশ কয়েক সপ্তাহ যাবত ট্রাম্পের পক্ষে মাঠে ছিলেন, তাদের মধ্যেও চির ধরেছে। দুদিন আগে ট্রাম্পের এক উপদেষ্টা বলেছেন যে, পুনরায় নির্বাচিত হলে চার বছরের জন্যে অভিবাসনের সকল দরজা সংকুচিত করবেন ট্রাম্প। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকেও ভিসা প্রদানে কঠোর কড়াকড়ির আওতায় আনা হবে।

এদিকে, সোমবার ট্রাম্পের এক টুইটে আভাস দেয়া হয়েছে ভোট গণনায় সময়ক্ষেপণ করা হলে অনিবার্য সংঘাতের। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পেনসিলভেনিয়া, টেক্সাস, নেভাদায় ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় নির্বাচন কমিশনের আবেদন অনুযায়ী সময় বরাদ্দ করার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের সমর্থকরা আদালতে গিয়েছিলেন। মাননীয় আদালত তা নাকচ করে দেয়ার পরই ট্রাম্প ঐ টুইট করেছেন। এ অবস্থায় ডেমক্র্যাট অধ্যুষিত বড় বড় সিটিতে হামলা, ভাংচুর, লুটতরাজের আতংক দেখা দিয়েছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যাসাচুসেট্‌স, ওরেগণসহ বিভিন্ন স্থানে বড়বড় স্টোরের সামনে কাঠের ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছে। মূল্যবান সামগ্রি স্টোর থেকে নিরাপদ স্থানে সরানো হচ্ছে। স্টেট ও সিটি প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে কোন ধরনের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়েছে। হোয়াইট হাউজ এবং আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যদিও কোন পক্ষ থেকেই সুনির্দিষ্ট কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি বড় ধরনের কোন হাঙ্গামার। জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদকালে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর এবং সহায়-সম্পদ লুটের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না স্টেটসমূহের গভর্নররা।

বাইডেন সোমবার সর্বশেষ নির্বাচনী সমাবেশ করেন ওহাইয়ো স্টেটের ক্লিভল্যান্ড এয়ারপোর্টে। সেখানে তিনি বলেন, ‘ওহাইয়োবাসী, আর একটি দিন অপেক্ষা করুন। এই যুক্তরাষ্ট্রকে যিনি বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন সেই প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেয়ার দিন হচ্ছে কাল মঙ্গলবার। এদিনে সেই প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করতে হবে যিনি এই জাতিকে রক্ষায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

মঙ্গলবারে আমরা সেই প্রেসিডেন্টকে হটাতে পারবো যিনি দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে ঘৃণাকে উষ্কে দিয়েছেন। ’ বাইডেন বলেন, ‘আমার কথা খুবই সাদামাটা। এই দেশের ক্ষমতার বলয়ে পরিবর্তন ঘটানোর পুরো ক্ষমতা আপনাদের হাতে। তার প্রয়োগ ঘটান ব্যালট বিপ্লবে। ’

করোনা নিয়ে তামাশায় মনক্ষুন্ন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রমণ-রোগের বিশেষজ্ঞ ড. এ্যান্থনী ফাউসিকে বরখাস্তের হুমকি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নির্বাচনের পরদিনই তিনি এ পদক্ষেপ নেবেন বলেও উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প।
এমন হুংকারের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বিকেলে যো বাইডেন বলেছেন, ‘আমাকে নির্বাচিত করুন, আমি অবশ্যই ফাউসিকে পুনরায় নিয়োগ দেব। ’ বাইডেন উল্লেখ করেন, ‘আমরাই বরখাস্ত করতে যাচ্ছি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ’

অপরদিকে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী সমাবেশে সোমবার আক্রমণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টকে। ট্রাম্প বলেছেন, আমাদের দেশ বড় বিপদে পড়েছে। পেনসিলভেনিয়ায় ডাকযোগে আসা ব্যালট নির্বাচনের পরদিনও বৈধ বলে গ্রহণের নির্দেশ দেয়ায় ক্ষুব্ধ ট্রাম্প বিচারকদের কটাক্ষ করেন।

উইসকনসিনের কেনোশা সিটিতে নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প বলেন যে, বিচারপতিরা রাজনৈতিক নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। তারা তার প্রতিপক্ষকে বিজয়ের পথ সুগম করে দিচ্ছেন জাল ভোটকে গণণায় নিয়ে। এর ফলে ক্ষুব্ধ জনতা সংঘাতে লিপ্ত হতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জনগণকে সংঘাতে উষ্কে দেয়ার ট্রাম্পের একটি টুইটকে চিহ্নিত করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্তৃপক্ষ।