যেভাবে জঙ্গিবাদে জড়ায় বাংলাদেশি তরুণী মোমেনা

মেলবোর্নে এক ব্যক্তিকে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় ৪২ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশি তরুণী মোমেনা সোমার ছোট বোন আসমাউল হুসনা সুমনা। জঙ্গি তৎপরতার জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি এখন বাংলাদেশের কারাগারে আটক।

বাংলাদেশ থেকে গত বছরের (২০১৮) ১ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া যান মোমেনা। এর নয় দিনের মাথায় মোমেনা মেলবোর্নে তার বাড়িওয়ালা রজার সিংগারাভেলুর ওপর ঘুমন্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে হামলা চালান। হামলার পরপরই অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ তাকে আটক করে। বুধবার সেখানকার আদালত ওই অপরাধে তাকে ৪২ বছরের কারাদণ্ড দেন।

গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার ওই ঘটনার পর ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা তাদের মিরপুরের বাসায় যান৷ তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে মোমেনার ছোট বোন আসমাউল হুসনা সুমনা তার হিজাবের নিচে লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে একজন পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা চালান। তখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সে এখন কারাগারে আছে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ডেপুটি কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে জানান,‘সুমনাকে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা তখন মোমেনার ব্যাপারেও তথ্য পেয়েছি । মোমেনা মূলত অনলাইন থেকে রেডিক্যালাইজড হয়েছে। আইসএস-এর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সিরিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে তার বিয়ের কথাও ছিলো। নজিবুল্লাহ আনসারীর সর্বশেষ তথ্য আমাদের কাছে নেই।

তিনি জানান,‘তারা দুই বোন। আর কোনো ভাই-বোন নেই। ছোট বোন সুমনা এখন কারাগারে আছে।গত বছর মোমেনা অস্ট্রেলিয়ায় আটক হওয়ার পর আমরা তাদের মিরপুরের বাসায় কথা বলতে গেলে সুমনা আমাদের ওপর ছুরি নিয়ে জঙ্গি স্টাইলে হামলা করে । তাদের বাবা তখন ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা নেই। ‘

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুমনাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাদের পর ওই দুই বোনের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে পাওয়া তথ্য সংবাদ তখন মাধ্যমকে জানানো হয়। কাউন্টার টেরররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুয়ায়ী, মোমেনা ঢাকার লরেটো স্কুল থেকে ২০০৯ সালে ‘ও’ লেভেল এবং ২০১১ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল পাশ করেন। এরপর গ্র্যাজুয়েশন করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে । নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। তখন তিনি হিজাব পরা শুরু করেন, বাসায় টিভি চালানোও বন্ধ করেন। ২০১৪ সালে সিরিয়া গিয়ে তিনি আইএস-এ যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তুরস্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপও পান তিনি। তবে ভিসা না পাওয়াতে তার তুরস্ক যাওয়া হয়নি।

মোমেনার সাথে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সেই নজিবুল্লাহ রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি মালয়েশিয়ান মেরিন একাডেমিতে পড়ার সময় বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান। ২০১৬ সালের পর থেকে তার সাথে পরিবারের সদস্যদের আর যোগাযোগ নেই । ২০১৪ সালে মোমেনার সাথে নজিবুল্লাহর বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও নজিবুল্লাহর পরিবারের অমতের কারণে বিয়ে হয়নি। নজিবুল্লাহর সাথে মোমেনার পরিচয় হয় আরও আগে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সিরিয়া যাওয়া নজিবুল্লাহর বন্ধু গাজী সোহান পরে ঢাকায় ফিরে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সে জানিয়েছে নজিবুল্লাহ তুরস্ক সীমান্তে মারা গেছে। গাজী সোহানের সাথেও মোমেনার যোগাযোগ ছিলো। মোমেনা অষ্ট্রেলিয়া যায় স্টুডেন্ট ভিসায়।

মোমেনার ছোট বোন সুমনা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন ২০১৫ সালের দিকে। মোমেনাই তাকে উদ্বুদ্ধ করেন। সুমনা মিরপুরের গার্লস আইডিয়াল স্কুল থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন। গ্রিনফিল্ড স্কুলে ভর্তি হলেও ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এরপর মেন্টরস নামে একটি কোচিং সেন্টার থেকে জিইডি করে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারেননি। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সুমনা জিজ্ঞাসাবাদে তখন জানিয়েছেন, তারা দুই বোন মিলে জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা করতেন। অনলাইনে নানা ধরণের জিহাদি ভিডিও দেখতেন। মোমেনা তাকে ছুরি চালানোর প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটি হামলা চালাবেন বলে মোমেনা জানিয়েছিলেন।

মোমেনার বাবা মনিরুজ্জামান একটি লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। তবে তিনি এখন অসুস্থ বলে জানা গেছে। তাই মিরপুরে নিজেদের ফ্লাট ছেড়ে এখন তিনি তার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক ড. আব্দুল আজিজের বাসায় থাকেন। মোমেনার মা ২০১৫ সালে মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তাদের গ্রামের বাড়ি। মোমেনার চাচা আব্দুল আজিজের সঙ্গে শুক্রবার যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে তিনি হোয়াটসঅ্যাপ-এ কল ব্যাক করেন। মোমেন ও সুমনার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘এ নিয়ে আমরা কোনো কথা বলতে চাইনা। মাফ করেন। মোমেনার বাবাও অসুস্থ তিনিও কথা বলবেন না। আগেও আমরা এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলিনি।তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই।’ জানা গেছে অস্ট্রেলিয়ায় মোমেনাকে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনগত সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি। ঢাকায় আটক সুমনার সঙ্গেও তারা যোগাযোগ রাখেন না।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সুমনা আটক হওয়ার পর তার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন সাংবাদিকেরা। তখনো তার বাবা কথা বলেননি। বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার নুরুজ্জামান লাবু ডয়চে ভেলেকে জানান,‘মোমেনার বাবা বা আত্মীয় স্বজন কেউই তখন সংবাদ মাধ্যমের সামনে আসেননি। পরে আমি তার চাচা আব্দুল আজিজের সঙ্গে দেখা করি তার ডিপার্টমেন্টে। কিন্তু তিনিও ওই দুই বোন সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, তারা যে আদর্শে জড়িয়েছে তার সঙ্গে আমাদের পরিবারের কারুর আদর্শ বা চিন্তার মিল নেই। তাদের দায়িত্ব তাদের।’

তবে লাবু তাদের বাসার গাড়ি চালকের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলেন। লাবু বলেন,‘গাড়ি চালক আমাকে জানিয়েছেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই মোমেনার মধ্যে তিনি পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। হঠাৎ করেই তিনি বাসায় টিভি দেখা বন্ধ করে দেন।’

লাবু জানান, ‘মোমেনার বোন সুমনাকে রিমান্ডে নেয়ার পর কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তাদের বাবা, আত্মীয়-স্বজন ও কয়েক জন বন্ধু বান্ধবকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেই জিজ্ঞাসাবাদ থেকেই তারা আমাদের তথ্য জানান। নজিবুল্লাহর সাথে মোমেনার সম্পর্ক হয়েছিল জঙ্গিবাদের মাধ্যমে।’