রমজানে খরচ দ্বিগুণ,হাঁসফাঁস অবস্থা নিত্যপণ্যের বাজারে

হাঁসফাঁস অবস্থা নিত্যপণ্যের বাজারে। দাম বেড়েছে রমজানকেন্দ্রিক পণ্যের। রোজায় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে কোনো প্রভাব পড়েনি বাজারে। এরই মধ্যে গত বছরের তুলনায় রমজানের কিছু পণ্যের দাম হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ইফতার-পণ্য ও ফলের দাম হাঁকা হচ্ছে ইচ্ছামতো। প্রতি বছরই সরকারের পক্ষ থেকে রমজানে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়। প্রতিদিনই ভোক্তা অধিদফতরের অভিযান চললেও বাজার সামাল দেওয়া যাচ্ছে না; যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের রোজার বাজার বেশি বেসামাল। গত বছরের রোজার আগের বাজারে যে পণ্যমূল্য ছিল, এবার তার দ্বিগুণের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই এবারের রোজায় ভোক্তাকে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ খরচ করতে হবে। নতুবা কম পণ্য কিনে অল্প খেয়ে রোজা রাখতে হবে-এমনটিই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

রমজানের অন্যতম ইফতারের প্রধান অনুষঙ্গ খেজুর। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি তাই খেজুর কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। গত বছরের তুলনায় এ বছর খেজুরের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এ বছর কেজিপ্রতি মানভেদে খেজুরের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। একদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে খেজুরের বাজারে এমন আগুন বলে মনে করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

 

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এ বছর মাঝারি মানের কামরাঙা মরিয়ম খেজুর প্রতি কেজি ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিয়ম ৮৫০ ও ইরানি মরিয়ম ১ হাজার টাকা। বাজারে তিউনিসিয়ান খেজুর প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, সৌদি আম্বার খেজুর ২ হাজার ২০০, আজোয়া (ছোট) খেজুর ১ হাজার ২০০, মদিনার সুগাই খেজুর ১ হাজার ২০০ ও মেগজল আম্বার খেজুর ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নাখাল মরিয়ম খেজুর ৫৫০, জিহাদি খেজুর ৫০০, সুকাই খেজুর ৪৫০, লিবিয়ান খেজুর ৫০০, বরই খেজুর ৫০০, ঢালাকাচা খেজুর ৫২০ ও দাবাস খেজুর ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে এসব খেজুর গত বছরের চেয়ে কেজি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

প্রায় সব ফল গত ১৫ দিনের ব্যবধানে ২০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। কমলা, মাল্টা, আঙুর ও আপেলের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০-৬০ টাকা পর্যন্ত। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ক্রাউন আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০, ফুজি আপেল ২৯০ থেকে ৩০০, মিসরের মাল্টা ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা। ভারতের সাদা আঙুর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে আনার ও আঙুর কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। মাঝারি আকারের আনার ৩২০ থেকে ৩৪০, কালো আঙুর ৩০০ থেকে ৩২০ এবং সাদা আঙুর ২১০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। চায়না কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায়। রোজায় ইফতারের আরেকটি জনপ্রিয় ফল আনারস। অন্যান্য বছর রসালো এ ফলটি মোটামুটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকলেও এবার এরও দাম বেশি। বড় সাইজের একটি আনারস খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি দামে। একই আনারস এক বছর আগে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মাঝারি ও ছোট আকারের আনারসের পিস ৪০-৫০ টাকা।

এদিকে দেশি ফল পাকা কলার ডজন আট-দশ দিন আগেও কেনা গেছে ৫০-৫৫ টাকায়। এখন ডজনে গুনতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। চাম্পা কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা। সবরি কলা ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকার মতো বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গ্রীষ্মের ফল তরমুজের বেচাকেনাও শুরু হয়েছে অল্প পরিসরে। বিক্রেতারা প্রতি কেজির দর রাখছেন ৬০ থেকে ৮০ টাকা। সে হিসেবে মাঝারি আকারের একটি তরমুজের দাম পড়ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

পেয়ারার কেজি সপ্তাহ দু-একের ব্যবধানে ১৫-২০ টাকা বেড়েছে। আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা, এখন ৭০-৮০ টাকা। বেদানা ৩৫০-৪০০, আতা ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাইব্রিড বরই ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে।

রমজান এলেই বাজারে চাহিদা বাড়ে ইসবগুলের ভুসির। ইফতারে এ পানীয় দিয়ে রোজা ভাঙতে পছন্দ করেন রোজাদাররা। তবে এবার রোজার আগেই প্রতিনিয়ত দাম বেড়েছে শরবতে ব্যবহৃত ইসবগুলের ভুসির। বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে পাইকারিতে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি মানভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা ছয় মাস আগে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ছিল। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছয় মাস আগে ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা।

গত বছর রোজার আগে পিঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৪০ টাকা। সেই দাম এখন প্রায় তিন গুণ। প্রতি কেজি পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২৫ টাকা। সে হিসেবে কেজিতে বেশি খরচ হবে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।

ইফতারে লেবুর শরবতের চাহিদা অনেক। সব শ্রেণির মানুষই ইফতারে কমবেশি লেবুর শরবত পান করে। তবে এবার লেবুর শরবত পান যেন বিলাসিতা। ৩০-৪০ টাকা হালির লেবু এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। কিছু কিছু জায়গায় পিস ২০ টাকা।

গত বছর রোজার সময় চিনির কেজি ছিল ১১৫-১২০ টাকা। এবার ১৫০ টাকা।

আলুর চপ ইফতারে রোজাদারদের বেশ প্রিয় খাবার। বাজারে আলু এখন ভরপুর। তবু কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২-৩৫ টাকায়। গত বছরের এ সময়ে ছিল ১৮-২০ টাকা। এবার কেজিতে বেশি গুনতে হবে ১৪-১৫ টাকা।

বছরে প্রায় ২ লাখ টন ছোলা আমদানি হয়। রোজায় দরকার হয় ১ লাখ টন। গত বছর বাজারে এ সময় ছোলার কেজি ছিল ৯০-৯৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১২ টাকা দরে। এবার কেজিতে বেশি খরচ করতে হবে ১৫ থেকে ১৭ টাকা।

ব্রয়লার মুরগি গত দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়েছে। দুই দিন আগে ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩৫ টাকায়। রোজার আগে আগে মাছের বাজারও গরম। পাঙাশ, কই, রুই, কাতলাসহ প্রায় সব ধরনের মাছের কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। ডিমের দামও গত বছরের তুলনায় কিছুটা বাড়তি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম কমায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু আবার দাম বেড়ে এখন আগের জায়গায় চলে গেছে গরুর মাংস। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়। গত বছর রোজার আগে ছিল ৭০০ থেকে ৭২০ টাকা, অর্থাৎ ভোক্তাদের এবার গরুর মাংসের কেজিতে এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত গুনতে হবে ৫০-৬০ টাকা।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মন্ত্রীরা বলছেন বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে; অথচ আজও আমি বাজারে গিয়ে দেখলাম সবকিছুর দাম বাড়তি। শুধু লেবুর ডজনই দেখা গেল ১০০ টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে। খেজুরের দাম প্রায় দু-তিন গুণ বেড়েছে। মন্ত্রী বলছেন বরই দিয়ে ইফতার করার জন্য। সেই বরইয়ের দাম এখন প্রায় ২০০ টাকা। সরকার যেসব কথা বলেছে আমরা বাজারে এর প্রতিফলন দেখিনি।’