বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার নতুন সরকারকে পশ্চিমাদের ‘অভিনন্দন’ কীসের ইঙ্গিত?

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। অথচ সেই দেশগুলোই পরে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে বলে বলছে সরকার।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ১২ জানুয়ারি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো গঠিত সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ সব রাষ্ট্রদূত অভিনন্দন জানিয়েছেন।’

যদিও ওইসব দেশের রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধিরা ‘অভিনন্দন’ জানানোর বিষয়ে কিছু বলেননি। সবশেষ এ মাসের ১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

তবে নির্বাচনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বেশ কয়েকটি দেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি’ বলে বিবৃতি দিয়েছিল।

তাহলে যে ‘অভিনন্দন’ জানানো হচ্ছে সরকারকে, তা ঠিক কী বার্তা বহন করছে? যদিও বিশ্লেষকদের অনেকেই একে নিছক ‘কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ’ হিসেবেই দেখছেন।

সরকারকে অভিনন্দন জানানোর কারণে নির্বাচন নিয়ে দেশগুলোর পর্যবেক্ষণ বা অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসবে বলেও মনে করেন না তারা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা এবং শ্রমনীতিকে ঘিরে তৈরি হওয়া উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে, বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচন নিয়ে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বেশ সরব দেখা যাচ্ছিল।

সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসছিল তারা। কিন্তু তাদের এ দাবি উপেক্ষা করে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে বাদ দিয়েই চলতি বছরের সাতই জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পরদিনই চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানায়।

কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোকে তখন ভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়। অভিনন্দন জানানোর বদলে তারা আলাদা বিবৃতি দিয়ে জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মানদণ্ড মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি’ বলে তারা মনে করে।

নির্বাচনের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরও পশ্চিমা দেশগুলো এখন বাংলাদেশের নতুন সরকারকে যে অভিনন্দন জানাচ্ছে, সেটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরই অংশ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসিকে বলেন, আসলে এটি একটি আনুষ্ঠানিকতার অংশ, কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। বস্তুত: যখন কোনও দেশে নতুন সরকার গঠিত হয়, তখন সে দেশে থাকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে থাকেন।

তবে এই অভিনন্দন জানানোর অর্থ এই নয় যে নির্বাচন নিয়ে দেশটি আগে যে পর্যবেক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটি পরিবর্তন হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, এখানে দু’টি ভিন্ন বিষয় রয়েছে। একটি হচ্ছে তারা তাদের পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরেছে। অন্যটি হচ্ছে, তাদের যেসব নিয়মিত কর্মকাণ্ড রয়েছে, সেগুলোও চালিয়ে যেতে হবে।

আমেনা মহসিনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, অভিনন্দন জানানো হলেও তারা নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে যে প্রশ্নটা তুলেছে, সে অবস্থান থেকে কিন্তু পরিবর্তন সব সময় নাও হতে পারে। আওয়ামী লীগ এর আগে বাংলাদেশে দুই দুইটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে। দেশে-বিদেশে বৈধতার কোনও সংকট সে সময় সেভাবে তৈরি হয়নি। এর কারণ হচ্ছে, নৈতিক মানদণ্ডে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা গেলেও, সাংবিধানিকভাবে তো প্রশ্ন তোলা যাচ্ছে না।

পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলায় একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো যে, কোন কোন দেশ হয়তো শেখ হাসিনার সরকারকে ‘স্বীকৃতি’ নাও দিতে পারে।

জানুয়ারির ১৮ তারিখে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ব্রিফিংয়ে তাকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন বলেছে যে বাংলাদেশে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, অবাধ এবং স্বচ্ছ হয়নি, তার মানে কি এই যে যুক্তরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চতুর্থ মেয়াদকে স্বীকৃতি দেবেনা?

মিলার ওই প্রশ্ন নাকচ করে দেন।

তবে তার আগেই আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এখন বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার প্রতিবেদনগুলোর বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করতে এবং অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে উৎসাহিত করছি।

তাহলে নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া জানালো, তার উদ্দেশ্য কী?

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়াগত ব্যাপারে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বা মতামত তারা প্রকাশ করতে পারে। স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়েও অনেক সময় তারা এটি করে থাকেন।

এর আগে ২০২২ সালের ২৪শে মে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে নতুন ভিসানীতির ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা ‘বাধাগ্রস্ত’ করবে, তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে।

এরপর দেশটির নতুন শ্রমনীতিকে ঘিরেও বাংলাদেশে বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হতে দেখা গিয়েছিল।

এখন নতুন সরকারকে ‘অভিনন্দন’ জানানোর পর সে উদ্বেগগুলো কি এবার কেটে গেছে?

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি মনে করি না যে, শঙ্কাটা একেবারে দূর হয়ে গেছে।

তবে নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য’ না হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কী ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেবে বা আদৌ কোন পদক্ষেপ নেবে কি-না, সেটি বুঝতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে বলেই মনে করেন তিনি।