শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রকে কতটা আপন মনে করেন?

শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ; এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ শ্লোগানে সারাবিশ্বের সঙ্গে দেশেও পালিত হচ্ছে এবারের মে দিবস। বলা হয় কর্মক্ষেত্র নাকি শ্রমিকের দ্বিতীয় বাড়ি। অর্থাৎ পরিবারের পরে এই জায়গাতেই কাটানো হয় সবচেয়ে বেশি সময়। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে শ্রমিক/কর্মীরা কতটা আপন মনে করেন তাদের কারখানা ও কর্মক্ষেত্রকে?

স্বাধীন বাংলা গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি শামীমা নাসরিন মনে করেন, শ্রমিকরা তাদের কারখানাকে আপন মনে করতেই পারে। শ্রমিকরা যদি তাদের বেতনের টাকা দিয়ে ঘরভাড়া দিয়ে, বাচ্চার পড়াশোনা করিয়ে, খাওয়া-দাওয়া ঠিক রেখে কিছুটা সঞ্চয় করতে পারে, তাহলে তারা কারখানাকে তার আপন মনে করে। মজুরিটাও সময়মতো পেলে তারা এভাবে ভাবতে পারে। কিন্তু এসবের অভাব দেখা দিলেই তখন দূরত্ব তৈরি হয় কারখানা ও শ্রমিকের মধ্যে।

শ্রমিক ও কারখানার মধ্যেকার দূরত্ব ঘোচাতে শ্রমিকের নিরাপত্তা এবং বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরির উপরে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন এই শ্রমিক নেতা।

শামীমা নাসরিন বলেন, কারখানা ও শ্রমিকের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন মালিকরা, তারা যদি মাসে অন্তত একবার কারখানা পরিদর্শনে আসেন তাহলে সম্পর্ক আরো গভীর হয়। তা না করে মালিকরা ঢাকার গুলশান বনানীতে নিজেদের অফিস খুলে বসেন আর মধ্যবর্তী একজন এসে কারখানা পরিদর্শন করে যান, ফলে শ্রমিকদের প্রয়োজন বা চাওয়া পাওয়ার কথা কখনোই মালিকের কাছে পৌঁছায় না।

তবে এভাবে শ্রমিক ও কারখানার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলে সেটা শ্রমিকের জন্যও যেমন ক্ষতিকর তেমন কারখানার জন্যও ক্ষতিকর মনে বনে করেন শামীমা নাসরিন।

তিনি আরও বলেন, এতে যেমন শ্রমিক তার উন্নয়ন করতে পারবে না, তেমন কাজে আন্তরিকতা না থাকায় কারখানারও খুব বেশি একটা উন্নয়ন হবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাই এগিয়ে আসতে হবে কারখানার মালিকদেরই।

একই কথা বলছিলেন বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব লেবার স্টাডিজ(বিলস) এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ।

তিনি বলেন, কাজের জায়গাটা অবশ্যই শ্রমিকরা সবচেযে আপন মনে করেন, তা না হলে যে মজুরিতে তারা এত কাজ করে সেটা কি সম্ভব। কখনো কারখানাতে আগুন লাগলেও তো দেখা যায় শ্রমিকরা নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও কারখানা বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু একটি পরিবারকেও মানুষ ঠিক তখনই আপন মনে করে নেয় যখন ওখানে সুখ দু:খের ভাগাভাগি থাকে। সেভাবেই শ্রমিক ও কারখানার মালিকদের মধ্যেও সুখ দু:খের ভাগাভাগি থাকলেই শ্রমিকরা আরো বেশি আপন ভাবা শুরু করবে কারখানাকে। কিন্তু এখানে দেখা যায়, শ্রমিকের কাজ দিয়ে কারখানার উন্নয়ন হয় কিন্তু শ্রমিকের কোনো উন্নয়ন হয়না। ফলে স্বভাবতই শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে পড়ে।

এই সম্পর্ক উন্নয়নে শ্রমিক ও মালিক সবারই সমান ভূমিকা রয়েছেন বলেও মনে করেন তিনি।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ এ বিষয়ে বলেন, শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কটাই এমন যে সেখানে একজন দিবে আরেকজন নেবে। কিন্তু মালিকরা শ্রমিকদের কোনো রকম সুযোগ সুবিধা না দিয়ে নিজেরাই সবটা গ্রহণ করতে চাইলেই বাড়ে দূরত্ব। তারা যদি কারখানার মুনাফার কিছু অংশ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করতেন তাহলে তারা ভাবতো আমি যে কাজ করছি সেটা আমার কাছেও ফিরে আসবে। তাছাড়া কর্মীদের নিয়োগের সময় যদি তাকে একটি নিয়োগপত্র দেওয়া হয় তাহলেও সে তার কারখানাকে আপন মনে করবে। সেখানে তার মাসিক বেতন, কর্মঘণ্টা, প্রতিবছরের ইনক্রিমেন্ট উল্লেখ থাকলে কাজের প্রতিও আগ্রহ বাড়বে, নিজেকে কারখানার অংম মনে করবে।

শ্রমিক ও কারখানার সম্পর্কের ব্যাপারটা পুরোপুরিই মানসিক কিন্তু এর সঙ্গে আইনী ও সাংস্কৃতিক বিষয়ও জড়িত বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, দেশে শ্রম আইন আছে। যদিও সেটা পূর্ণাঙ্গ নয় তবুও সেটার প্রয়োগ ঠিকমতো হলেও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত হবে। সঙ্গে এক্ষেত্রে সরকারেরও কিছু নীতিগত দায়িত্ব রয়েছে। শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে কথা বলার সুযোগ পেলেও নিজেদের বঞ্চিত ভাববে না।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মন্তব্য জানতে চাইলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।