সাতক্ষীরায় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে মাছের দাম।। বিপাকে ব্যবসায়ীরা

দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের মাছ উৎপাদনের উন্নতম জেলা হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা। আর সেই সাতক্ষীরায় মাছের বাজারে মাছ কম থাকায় অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে মাছের দাম। এতে করে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। মূলত করোনা মহামারির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দাম কমলেও মাছ কিনতে পারছে না মানুষ। ব্যবসায়ীরাও ঘের থেকে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছেন। এতে সরবরাহও কমেছে মাছের।

ঘের ব্যবসায়ীদের দাবি মাছ চাষ বেশি হওয়ায় উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও কমেছে।

আর মৎস্য অধিদফতর বলছে, করোনা কালীন সময়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় মাছের দাম কমেছে।

সাতক্ষীরায় মাছের বড় বাজার হলো সুলতানপুরের মাছ বাজার। সেখানে প্রতিদিন তিন থেকে চার টন মাছ খুচরা বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে। আগে যেখানে বিক্রি হতো ৮ থেকে ১০ টন মাছ।

মাছ বাজার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম বলেন, মাছের বাজারের অবস্থা বেশ খারাপ। অনেক ব্যবসায়ী দিন শেষে মাছ বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে দাম কম থাকলেও সরবরাহ কমে যাচ্ছে।

সরে জমিনে দেখা গেছে, বাজারে রুই, তেলাপিয়া ও সিলভার কার্প মাছের সরবরাহ বেশি। এছাড়া হরিণা চিংড়ি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা ও বড় সাইজের চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা করে। এই মাছের মূল্য আগে ছিল ৫০০-৫৫০ টাকা।

ভেটকি মাছের মূল্য প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০০-৫৫০ টাকা। কৈ মাছের কেজি ৩০০ টাকা থেকে নেমে হয়েছে ২০০ টাকা। গ্রেটের বাগদার কেজি বর্তমানে ৮৫০ টাকা। আগে ছিল ১২০০-১৪০০ টাকা। তেলাপিয়া মাছের কেজি ৯০ থেকে নেমেছে ৭৫ টাকায়।

এছাড়া পারসে মাছের দাম ৩৫০ টাকা থেকে নেমে হয়েছে ১৫০-২৫০ টাকা। মৃগেল মাছ ১০০ টাকা, দাতিনা মাছ ১৭০ টাকা ও রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। মাছের দাম প্রতি কেজিতে ৩০-৪০ টাকা কমেছে। ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪শ টাকা প্রতি কেজি। সব মাছেরই দাম কমেছে বলে জানিয়েছেন খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীরা।

বড় বাজারের মাছ ব্যবসায়ী গোলাম হোসেন বলেন, এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ ট্রাক বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ট্রান্সপোর্ট হচ্ছে। এসব ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।

মাছ ব্যবসায়ী পরিতোষ রায় জানান, আমি প্রতিদিন ৩শ কেজি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঠাচ্ছি। আগে ৬০০-৭০০ কেজি করে পাঠাতাম। এখন চাহিদা কম থাকায় পাঠাতে পারছি না।

তিনি আরো বলেন, উত্তরবঙ্গে বর্তমানে সামুদ্রিক মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেখানে মাছের চাষ হওয়ার ফলে আমাদের এখানকার মাছের চাহিদা কম।

অন্যদিকে সাতক্ষীরার সবচেয়ে মাছের বড় আড়ত বিনেরপোতা মাছ বাজারে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয়।

বিনেরপোতা মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি আরশাদ আলী জানান, গত বছর এ সময় প্রতিদিন মাছ কেনাবেচা হতো দেড় থেকে দুই কোটি টাকার। এ বছর সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টাকার মাছ কেনাবেচা হয়েছে। ঢাকার বড় মাছের ক্রেতারা এখন আসছেন না।

তিনি আরো বলেন, প্রতি কেজি মাছের মূল্য কেজিতে ৩০-৪০ টাকা কমেছে। দুই কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ আগে পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়েছে ১১০-১২০ টাকা এ বছর বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকায়। একই ওজনের একটি রুই মাছ ২১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে পাইকারিতে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।

ট্যাবলেট মাছ বিক্রি হতো ১২০-৩০ টাকায় এখন হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। ১০-১২ কেজি ওজনের গলদা চিংড়ি প্রতি কেজি বিক্রি করছি ৬৯০ টাকায়। একই ওজনের মাছের মূল্য আগে ছিল ৯৫০-১০০০ টাকা।

বিনেরপোতা বাজারের মাছের কমিশন এজেন্ট ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান পলাশ বলেন, আড়তে মাছ আসলে আমরা সেগুলো বিক্রি করে কমিশন নিই। আমাদের কোনো লস নেই তবে ঘের ব্যবসায়ীরা আছেন লোকসানে। আড়তে প্রতিদিন তিন-চার লাখ টাকার মাছ আসছে বলে জানান তিনি। বিনেরপোতা মাছের আড়ত থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে ৯ থেকে ১০ ট্রাক মাছ।

সাতক্ষীরা মৎস্য অধিদফতরের কার্যালয় থেকে জানা যায়, জেলায় এ বছর বাগদা চাষ হয়েছে ৬৬ হাজার ৮৬২ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ২১ হাজার ৪৪১ মেট্রিক টন। তাছাড়া গলদা চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ছয় হাজার ৫৪২.৫ মেট্রিক চন। সব মিলিয়ে জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন।

ঘের ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান জানান, মাছে ব্যবসা নেই, আবার কোনো মানও নেই। আগে মাছের চাষ কম ছিল দাম বেশি ছিল, মানও ছিল বেশি। আমার ৫শ বিঘা মাছের ঘের রয়েছে। দাম কম থাকায় মাছ ধরছি না। বড় ঘের ব্যবসায়ীরাও কেউ মাছ ধরছে না। স্টক করে রেখেছে। মাছের দাম বাড়লে তারা মাছ ধরবেন। ৫০ বিঘা মাছের ঘের করেছেন তালা উপজেলার বিষুকাটি গ্রামের ইনসাফ মোল্লা। তবে বিপাকে পড়েছেন এ ব্যবসায়ী।

তিনি বলেন, চার লাখ টাকার মাছ ছেড়েছিলাম ঘেরে। মাছগুলো এখন বিক্রি উপযোগী হয়েছে। তবে মাছের দাম কম হওয়ায় যে খরচে মাছ পালন করছি বিক্রির সময় সেই মূল্য ওঠাতে পারছি না। আট-দশ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ছয়-সাত লাখ টাকার মাছ। হিসাব করলে দেখা যায় কোনো লাভ হয়নি বরং লোকসান হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম কমেছে মাছের। ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ সঠিক নয়। মূলত করোনাকালীন সময়ে মানুষের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মাছ ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ফলে ক্রেতা না থাকায় মাছের দাম কমেছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।