স্যাটেলাইটে ধরা পড়ল রোহিঙ্গা গ্রামে অগ্নিসংযোগের দৃশ্য

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সীমান্তরক্ষী পুলিশের সঙ্গে সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষের ঘটনায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়টির নিরীহ মানুষদের ওপর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে।

গত পাঁচ দিনে আটশ’ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন অধিকার কর্মীরা। নিহতের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও রয়েছে।

অভিযানের নামে নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে।

সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে অভিযোগ করেছেন, রাখাইনে তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তারা তাদের ঘরবাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা তাদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার যে অভিযোগ করছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে এর মিল পাওয়া গেছে।

এসব ছবি থেকে রাখাইনের অন্তত দশটি জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানায় এইচআরডব্লিউ।

বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, যেসব জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তা একশ’ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত। যা গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যেসব জায়গায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অগ্নিসংযোগ করেছিল তার চেয়েও পাঁচগুণ বড়। ওই সময় স্যাটেলাইটের ছবি বিশ্লেষণ করে এক হাজার পাঁচশ ভবন আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার তথ্য বের করেছিল এইচআরডব্লিউ।

গত ২৫ আগস্ট ভোররাতে রাখাইনের তিনটি জনপদে (টাউনশিপ) সীমান্তরক্ষী পুলিশের দুই ডজন চেকপোস্টে হামলা করে রোহিঙ্গা অধিকার রক্ষা বিষয়ক সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)।

এ ঘটনার পর মিয়ানমার সরকার ৩৩তম লাইট ইনফেন্ট্রি ব্যাটালিয়নসহ সামরিক বাহিনী সদস্যদের মোতায়েন করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে নিরাপত্তা অভিযান তীব্রতর করে। এ সময় আরসা বিদ্রোহী ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরষ্পরের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ করে। অন্যদিকে উভয় পক্ষে চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যে হাজার হাজার সাধারণ রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায়।

এইচআরডব্লিউ জানায়, অভিযান শুরুর পর ২৫ আগস্ট দুপুরে রাতেডং টাউনশিপের জে ডি পিন এবং কোয়ে তান কাউক গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শনাক্ত করা গেছে।

এরপর ২৮ আগস্ট মধ্য সকাল থেকে দুপুর শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময়ে মংডু শহর এবং মংডু টাউনশিপের কিউন তাং ও পা ডা কার তাং, পু খার লি, গোন নার, থা ইয়ে কোন তান ও গোয়া সন গ্রামের আটটি জায়গায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।

রাখাইনের আরও অনেক জায়গায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও স্যাটেলাইটে তার দৃশ্য ধরা পড়েনি বলে জানায় এইচআরডব্লিউ। সংস্থটির দাবি, স্যাটেলাইটের ক্যামেরার রেজুলেশনের সীমাবদ্ধতা ও বর্ষাকালীন মেঘমালার কারণে এসব অগ্নিসংযোগের দৃশ্য শনাক্ত করা যায়নি।

স্যাটেলাইটের ছবিতে যেসব জায়গায় অগ্নিসংযোগের কথা শনাক্ত করা হয়েছে তার সঙ্গে অগ্নিসংযোগের বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনের বিবরণের তুলনা করে দেখার কথা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাটি। তাদের দাবি, স্যাটেলাইটের দৃশ্য ও কিছু ঘটনার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।

এইচআর ডব্লিউ জানায়, তারা তাং পিও লেট ইয়ার নামের একটি গ্রামে আগুন জ্বলার বিষয়টি শনাক্ত করেছে। সংস্থাটি জানায়, ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তি বলেছেন তিনি দেখেছেন মিয়ানমার সেনারা লোকজনকে ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিয়ে তাড়া করে গুলি করছে এবং ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, এখন সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

এ অবস্থায় স্বাধীনভাবে পর্যবেক্ষণ করে অগ্নিসংযোগের ঘটনা কে বা কারা ঘটিয়েছে তা নির্ধারণ করতে এবং মানবাধিকার হরণের অভিযোগ যাচাই করতে অবরুদ্ধ রাখাইনে প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ।

সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, নতুন স্যাটেলাইট তথ্যের আলোকে দাতা ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়া এবং মিয়ানমার সরকার যেন রাখাইন রাজ্যে চলমান ধ্বংসের পরিমাণ প্রকাশ করে তার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

তিনি বলেন, বিদ্রোহীদের ওপর সব কিছুর দোষ চাপানোর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার রাখাইনে নিপীড়ন বন্ধ এবং নির্যাতনের নানা ঘটনার তদন্ত করার আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা এড়াতে পারে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের অক্টোবরে সীমান্তরক্ষী পুলিশের চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় নয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়। এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে ব্যাপক নিপীড়ন করে।

গত মার্চ পর্যন্ত ছয় মাস ধরে চলা এই অভিযানকালে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা নিহত, অনেক নারী ও কিশোরী ধর্ষিত এবং কয়েক হাজার পুরুষ গ্রেফতার হয়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।