হজের পর থেকে ছবি করছি না : অভিনেত্রী ডলি জহুর

ডলি জহুর, এক নামে পরিচিত। অসংখ্য ছবির মায়াবী মুখ। তার অভিনয় দর্শককে টেনে নিয়েছে নিজের সংসার, সমাজে। শত টানাপোড়েনেও চোয়ালবন্ধ অবস্থান কিংবা সুখের আতিশয্যে নিজেকে মেলে ধরার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।

একাধারে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ডলি জহুর। পেশার স্বীকৃতিস্বরূপ দু’বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ১৬১টি ছবি করেছেন এই অভিনেত্রী।

ব্যক্তি ও অভিনয় জীবন, একান্ত ভালো লাগা, না লাগা, তরুণ প্রজন্মের কাজ- সার্বিক বিষয়ে খোলামেলা মতামত তুলে ধরেছেন ডলি জহুর।

মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র- তিন ক্ষেত্রেই আপনি সফল। কিন্তু, এখন পর্যন্ত কোনটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না- কোনো ক্ষেত্রেই এমনটি কখনো মনে হয়নি। যখন যেটা করি, মন দিয়েই করার চেষ্টা করি। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র সব জায়গাতেই দীর্ঘদিন আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করেছি। সবার ক্ষেত্রেই আত্মবিশ্বাসটা জরুরি।

মঞ্চ অভিনয়ে কিভাবে যুক্ত হলেন?

স্বাধীনতার পরে ইউনিভার্সিটির ছাত্রী আমি। ওই সময় নাট্যচক্রের কাজ শুরু করি। ম. হামিদ আমার গুরু। ওটা করতে করতেই জহুরের সঙ্গে পরিচয়। এরপর তার ‘কথক’ নাট্যগোষ্ঠীতে কাজ শুরু করলাম।

তখন কি কাজটি এতটা সহজ ছিল? পরিবার থেকে কোনো বাধা আসেনি?

হ্যাঁ, অতটা সহজ ছিল না। মা খুব করে বাধা দিতেন। কিন্তু, বাবার মৌন সম্মতি পেতাম। হয়ত এজন্যই আজকের ডলি জহুর হতে পেরেছি। গার্লস গাইডের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেও মা বাগড়া দিতেন, বাবার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করতেন। কিন্তু, বাবা আমাকে চোখ ইশারা দিয়ে বলতেন, তুমি যাও, আমি দেখছি। মা আমাকে সংসারের কাজ শিখতে বলতেন। হুমকি দিতেন, শাশুড়ি এক দুয়ার দিয়ে বরণ করে নিবেন, কাজ না পারলে আরেক দুয়ার দিয়া ঘাড় ধাক্কা দিবেন। কিন্তু, ওই যে, বাবার আসকারা পেয়ে ওসব শুনতে শুনতে হদ্দ হয়ে গিয়েছিলাম।

মঞ্চ অভিনয়ে এমন কোনো চরিত্র কি মনে পড়ে, যেটি আপনাকে অমরত্ব দিয়েছে?

সব চরিত্রেই নিজেকে যথাযথভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আরণ্যকের ‘মানুষ’ নাটকটার অনেক শো করেছি। সেখানে আমি একমাত্র নারী চরিত্র। এটা আমাকে অভিনয় জগতে নিঃসন্দেহে শক্ত অবস্থান দিয়েছে।

নতুন কোনো নাটক বা সিনেমায় অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোন বিষয়টিকে প্রাধান্য দেন?

আমি সব সময় চ্যালেঞ্জিং চরিত্র করতে ভালোবাসি। কেউ কাজের জন্য বললে, সেখানে সত্যিকার অর্থেই আমার জন্য কিছু আছে কি না তা দেখি। নাকি শুধু ডলি জহুর ব্র্যান্ডটা তারা বিক্রি করতে চাচ্ছে, তা বিবেচনায় নেই। স্ক্রিপ্ট না দেখে কোনো সিনেমা বা নাটকে আমি অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেই না।

বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে যদি কিছু বলতেন-

আমি তো চলচ্চিত্রে অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছি। নিয়ত ছিল হজ করার পর আর অভিনয় করব না। ২০১২ সালে আল্লাহ আমাকে হজ করার তৌফিক দিয়েছেন। এরপর থেকে আর কোনো ছবিতে অভিনয় করিনি। তবে নাটক এবং দু’তিনটা সিরিয়ালে কাজ করছি। যেমন: সিরিয়াল ‘ক্যাট হাউজ’, নাটক ‘মেঘে ঢাকা শহর’। এগুলো টিভিতে প্রচার হচ্ছে। আর ‘নোয়াশাল’ করছি।

আপনাদের সময় আর এখনকার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন-

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়, এটা স্বাভাবিক। অভিনয়েও পরিবর্তন এসেছে। এখন প্রযুক্তিগতভাবে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। কিন্তু, এর অর্থ সব কিছুতে আমরা উন্নতি করেছি, তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে তো কাজের মানই ঠিক রাখা কঠিন হচ্ছে। পরিমাণ বেশি হলে তো মান থাকবেই না। আগে টিভিতে কাজ করলে তো আমরা টাকার কথা চিন্তাই করতাম না। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা আসে তো কোনো রকমে কাজ শেষ করেই টাকা নিয়ে চলে যায়।

‘এই সব দিন রাত্রি’ করেছি, তখন চার দিন কাজ করে মাত্র ৫০০ টাকা পেতাম। ওটাই অনেক বিরাট কিছু মনে হতো। আর এখন সিঙ্গেল নাটকে ৫০ হাজার, ১ লাখ টাকা নেয় নায়ক-নায়িকারা। তারাই যদি এত নেয়, বাকিরা কি পাবে? এত টাকা নেয়ার পরও তারা এমন অভিনয় করে যা দেখলে পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা হয়। অবাক বিষয় যে, এই ট্রেন্ড দিনকে দিন বাড়ছেই। এর প্রতিবাদ কিংবা লাগাম টানার কেউ নাই।

কিন্তু, কেন এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন?

এটা বলা একেবারেই মুশকিল। কারণ, চ্যানেল থেকেই বলে দিচ্ছে অমুককে নিয়ে নাটক কর। সেই নায়ক-নায়িকার দর্শক  গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, তা দেখার প্রয়োজন মনে করে না। তখন পরিচালক-প্রযোজকরাও বাধ্য হচ্ছেন। আসলে পুরোপুরি দোষটা চ্যানেলেরও না, এখানে দীর্ঘদিন ধরেই একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে।

এ প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ-

না, না, কিসের পরামর্শ! না কাউকে পরামর্শ দেয়ার কোনো শক্তি আছে আমার, না এরা কারও পরামর্শ গ্রহণ করে। এরা কোথা থেকে, কি করছে- আমরা তো জানিই না। পরামর্শ দেব কিভাবে?

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দু’দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। গোটা বিশ্বেই আপনাকে এক নামে চেনে। এরপরও কি কখনো কোনো অতৃপ্তি নাড়া দেয়?

আমার ভালবাসার জগত অভিনয়। এটি করতে গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। এখন মাঝেমাঝে অনুভব করি, কাজের জন্য স্বামী-সন্তানকে সময় দিতে পারিনি। এটা আমার দেয়া উচিত ছিল। এসব ভাবলে এটাই জীবনের অতৃপ্তি মনে হয়।

সৌজন্যে : পরিবর্তন