হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার বিভাগ চেয়ে ছয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বিবৃতি

সুপ্রিম কোর্ট দিবস স্মরণীয় করে রাখার জন্য বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য ও হস্তক্ষেপমুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ছয় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

তারা আশা করছেন, অধস্তন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ সংবিধান ও সর্বোচ্চ আদালতে রায়ের প্রতি সম্মান দেখাবে।

সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালনের আগের দিন সোমবার এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, ব্যারিস্টার এ এফ হাসান আরিফ ও ফিদা এম কামাল।

দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর সম্প্রতি অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশ করে সরকার। সেটি গ্রহণ করা হবে কি হবে না তা নিয়ে মঙ্গলবার উচ্চ আদালতের আদেশ দেয়ার কথা রয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭২ সালে ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এবার প্রথম, সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালিত হতে যাচ্ছে ২ জানুয়ারিতে। এমন একটা সময়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে যখন এদেশের বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ অভিভাবক প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য।

বাংলাদেশের সংবিধান এর অখণ্ডতা রক্ষা, সমর্থন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাগরিকদের সব মৌলিক অধিকার বলবৎ করার আদেশ বা নির্দেশ, সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারের পাশাপাশি সংবিধানের যেকোনো অংশের সঙ্গে সঙ্গতিহীন কোনো আইন বা সরকারি বিধি বা আদেশ যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোনো প্রশ্ন কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রায় ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করা হয় বিবৃতিতে।

তাতে বলা হয়, এসব রায়ের মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে জনগণের অধিকার রক্ষার্থে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও ভারসাম্য কোনো অবস্থাতেই পরিবর্তন ও ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।

যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি মাসদার হোসেন মামলার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি পুনঃ স্মরণ করতে গিয়ে দেখা যায় যে অধঃস্তন আদালতের ক্ষেত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিধি প্রণয়নে সংবিধানের মূলধারার বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। এটা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বকীয় অবস্থানের জন্য সংবিধান যে সুরক্ষা দিয়েছে তা সংরক্ষণ/বাস্তবায়ন করা সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্ব। দীর্ঘ ৪৬ বছর কালক্ষেপণের পর এই বিধিগুলো বর্তমানে অধঃস্তন বিচার বিভাগের জন্য সরকার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৩ অনুযায়ী করেছে, অথচ উক্ত ১৩৩ অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের জন্য প্রণীত হওয়ার বিষয়টি সংবিধানের কর্ম বিভাগের জন্য প্রযোজ্য।’

‘এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, অধঃস্তন আদালতে বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ, পদোন্নতি প্রদান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ শৃঙ্খলা বিধান-সংক্রান্ত বিষয় সংবিধানে দুটি অনুচ্ছেদ ১১৫ ও ১১৬ তে পৃথকভাগে বিচার বিভাগের অংশে প্রণীত আছে। তথাপিও উক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অধঃস্তন বিচার বিভাগের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের অধঃস্তন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির লঙ্ঘনসহ মাসদার হোসেন মামলার রায়ের সাথেও সাংঘর্ষিক।’

উক্ত আইনগুলো সংবিধানের অধীনে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দুটি বিভাগের (আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ) সাথে যথাযথ পরামর্শ ব্যতীত প্রণয়ন করা হয়েছে বলে বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, অধঃস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ ও বদলি বিষয়ের বিধিমালা দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর নির্বাহী বিভাগ ও মন্ত্রণালয় এমন একটি সময়ে স্থানান্তরিত হয়েছে যখন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য এবং যা সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের সাথে প্রয়োজনীয় অর্থবহ পরামর্শ ব্যতীত প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধঃস্তন আদালতকে ১৯৯৯ সালের পূর্বের যুগে নির্ধারিত করার শামিল।

এ বিষয়ে জনগণ ও সুশীল সমাজকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের ঐকমত্যের মাধ্যমে একত্র হয়ে দেশের সাংবিধানিক ভারসাম্য রক্ষা করার প্রচেষ্টাকে একত্র করে দৃঢ় ও সংকল্পিতভাবে জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধার করা এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ভিত্তিতে একটি উপযুক্ত স্বাধীন ও পৃথক বিচার বিভাগের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প নেই। ’

প্রথমবার সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালন করার উদ্যোগকে স্বাগত জানান জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা। পাশাপাশি দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে তারা বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের আধিপত্য ও হস্তক্ষেপমুক্ত একটি পরিবেশ তৈরি করার আহবান জানান।

তারা আশা করেন, মাসদার হোসেন মামলার রায়ের মাধ্যমে অধঃস্তন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগ সংবিধান ও সর্বোচ্চ আদালতে রায়ের প্রতি সম্মান দেখাবেন।