হিন্দু-মুসলমান-শিখ সকলে আমার সন্তান, বললেন পুত্রহারা ইমাম

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে ধর্মীয় উত্তেজনার জেরে সদ্য পুত্রহারা ইমাম মহম্মদ ইম্মাদুল্লাহ’র আবেদনে সাড়া দিয়ে সম্প্রীতি ফিরেছে এলাকায়। গত সপ্তাহের এই উত্তেজনার পর স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে আসানসোল-রানিগঞ্জের বাসিন্দারা।

সম্প্রতি ধর্মীয় উত্তেজনার জেরে ওই ইমামের ছোট ছেলে সিবঘাতুল্লাহ (১৬) নিহত হয়। সে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তবে পরীক্ষার ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি।

ইম্মাদুল্লাহ ওই এলাকার স্থানীয় জাহাঙ্গির মহল্লার নুরানি মসজিদের ইমাম। নিহত সন্তানের স্মৃতি আঁকড়ে ‘প্রকৃত ভারতবর্ষ’কে খুঁজছেন তিনি।

রোববার মসজিদে বসে ৪৮ বছর বয়সী এই ইমাম বলেন, ‘আমি তো ইমাম। হিন্দু-মুসলিম-শিখ, প্রত্যেকেই আমার সন্তান। তাছাড়া ভারতবর্ষের সংস্কৃতিই হল সম্প্রীতি। সিবঘাতুল্লাহ’র স্মৃতির মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সেই প্রকৃত স্বরূপই খুঁজছি। যতদিন বেঁচে থাকব মানুষে মানুষে ভালবাসার জন্য কাজ করে যাব।’

এর আগে সন্তান শোক বুকে নিয়ে পুত্রের মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েই উত্তেজিত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লা আমার সন্তানকে যতটুকু জীবন দিয়েছিলেন, ও ততটুকুই পেয়েছে। আপনারা শান্ত না হলে আমি মসজিদ এবং আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।’

তার এমন আবেদনে এলাকায় সম্প্রীতি ফিরেছে বলে মনে করছেন আসানসোলের বাসিন্দারা।

ইম্মাদুল্লাহরা শতাধিক বছর ধরে আসানসোলেরই বাসিন্দা। তার বাবাও ছিলেন শহরের এক মসজিদের ইমাম। উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের এক মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে মাত্র ২০ বছর বয়সে ইমাম হন ইম্মাদুল্লাহ।

তার কথায়, ‘আমি রামায়ণ সম্পর্কে জানি। যারা হানাহানি করে, তারা না জানে রামকে, না বোঝে ধর্ম। তারা দিকভ্রান্ত। তবে পশ্চিমবঙ্গে এসব করা সহজ নয়। দেখুন, মাত্র সাতদিনের মধ্যেই সম্প্রীতি ফিরে এসেছে।’

ইমাম জানান, তার এবং স্ত্রী খাদিজাতুলকুব্রার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান ছিল সিবঘাতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ওর মায়ের দিকে তাকাতে পারছি না। কাঁদতে কাঁদতে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে হিন্দু-মুসলিম প্রতিবেশীদের ফেলে কীভাবে বাড়ি যাব! অধিকাংশ সময় মসজিদেই থাকছি।’

ইমামের আরও তিন ছেলে রয়েছে। প্রত্যেকেই দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। ইমাম বলেন, ‘ছোটছেলে সিবঘাতুল্লাহই ছিল সবচেয়ে মেধাবী। মাধ্যমিকের ফল বের হলে দেখবেন ৮০ শতাংশের উপর নম্বর পাবে। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ফর্মও তুলেছিল সে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ইমামের সঙ্গে দেখা করছেন। অনুরোধ করছেন তিনি যেন এলাকা ছেড়ে চলে না যান। ইমাম বলেছেন, ‘আমি সবিনয়ে বলছি, আমরা সকলেই যদি দায়িত্ব নিই, তাহলেই গোলমাল মিটবে।’

এলাকার অসীম বিশ্বাস, মনা যাদবেরাও শ্রদ্ধা করেন ইমামকে। মনার কথায়, ‘শনিবার তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বললেন, এক ছেলে গিয়েছে তো কী হয়েছে! তোমরা সকলেই আমার সন্তান।’

এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যেই প্রচার শুরু হয়েছে, ইমাম নাকি আসানসোলের বাসিন্দাই নন। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই হেসে ফেললেন ইম্মাদুল্লাহ। নিজের এবং মৃত পুত্রের আধার কার্ড দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই দেখুন পরিচয়পত্র। কিন্তু এসব দেখাতে হবে কেন বলুন তো! এই শহরের সঙ্গে আমার নাড়ির টান। হাজার চেষ্টাতেও কেউ তা ছিঁড়তে পারবে না।’