৭৭৪ জনের নিরাপত্তায় ‘ক্লান্ত’ এক পুলিশ

উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। খাদ্যশস্য উৎপাদন ও রফতানি, ক্রিকেট থেকে থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক নানা সূচকে অন্যতম সফল দেশ হিসেবে বিশ্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে উন্নত দেশগুলোর কাছে রোল মডেল হয়েছে উঠেছে এশিয়ার ‘পাওয়ার প্যাক’খ্যাত বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের আপামর জনগণের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় পুলিশের সংখ্যার অনুপাত অনেক অনুন্নত দেশের থেকেও কম এখানে। এমনকি, এশিয়ার প্রায় সব দেশেই বর্তমানে পুলিশ-জনগণের অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।খবর জাগো নিউজের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১০ লাখ এবং নারীর ৮ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার। আর পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৭৫ জন (নবগঠিত এন্টি টেররিজম ইউনিট ও হাতিরঝিল থানার ৫৮১ জন সহ)।

পুলিশের এই ২ লাখ ৯ হাজার জনের মধ্যে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ইন্ডাস্ট্রিয়াল, হাঁইওয়ে, রেলওয়ে, টুরিস্ট ও নৌ-পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশ টেলিকম অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট (পিটিআইএম), স্পেশাল প্রোটেকশন ব্যাটালিয়ন এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ।

দেশের মোট জনসংখ্যা ও মোট পুলিশ সদস্য সংখ্যার হিসেবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৭৪ জন মানুষের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন একজন পুলিশ সদস্য। তবে কাগজে কলমে এই সংখ্যা ৭৭৪ জন হলেও বাস্তবে ১ হাজারের বেশি। কারণ পুলিশের মোট জনবলের এক-তৃতীয়াংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠান ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় ব্যস্ত থাকে।

এছাড়া বড় একটা অংশ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতের মত বড় দেশেও পুলিশের বিপরীতে এই সংখ্যা ৬৬০ জন। দেশটির প্রথম সারির গণমাধ্যম জি নিউজের তথ্য মতে, সে দেশের ১৩২ কোটি জনগণের নিরাপত্তায় রয়েছে প্রায় ২০ লাখ পুলিশ।

এছাড়াও স্ব স্ব দেশের গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৫৬ লাখ জনসংখ্যার দেশ সিঙ্গাপুরে একজন পুলিশ ১৪০ জনের নিরাপত্তা দেয়। মালয়েশিয়ায় পুলিশ জনগণের অনুপাত ২৪৯ (জনসংখ্যা ৩ কোটি ১১ লাখ), থাইল্যান্ডে ২৮০ (জনসংখ্যা ৬ কোটি ৮৮ লাখ), হংকংয়ে ১৮২ (জনসংখ্যা ৭৩ লাখ) এবং ফিলিপাইনে ৬৬৫ (জনসংখ্যা ১০ কোটি ৩৩ লাখ) জনের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকে।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস বলেন, ১৬ কোটি মানুষের জন্য ২ লাখ ৯ হাজার পুলিশ পর্যাপ্ত নয়। তবে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সর্বশেষ ৫৮১ জন জনবল নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে পুলিহের বিশেষায়িত এন্টি টেররিজম ইউনিটকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালের গুলশানের হলি আর্টিসানে হামলার পর থেকেই অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে তাদের। সব এলাকায় নিরাপত্তা ও টহল বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পুলিশ থাকছে, অনেক ব্যাক্তিগত অনুষ্ঠানেও নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রতিদিনের মোবাইল কোর্টের নিরাপত্তার ডিউটিও থাকে। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকায় গড়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা ডিউটি করছে যা খুবই কষ্টকর। তবে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ডিউটি করতে হচ্ছে আমাদের।

সম্প্রতি জনবল সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে খোদ ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকেও। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো একটি চিঠিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, জনবল ঘাটতি থাকায় পুলিশ সদস্যদের ১৬-১৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে। এতে তারা ক্লান্ত ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে ও আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বড় সংকট দেখা দিলে ক্লান্ত দুর্বল মনোবলসম্পন্ন এ পুলিশ দিয়ে তা মোকাবেলা দুরূহ হয়ে পড়বে ।

অতিরিক্ত ডিউটির এই প্রভাব পড়ছে পুলিশের শরীরে। ২০১৫ সালের পুলিশ হাসপাতালের সর্বশেষ এক জরিপ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ শতাংশ পুলিশ সদস্য পেপটিক আলসার, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হৃদরোগে ভুগছেন।

এছাড়া ট্রমা অ্যান্ড ফ্র্যাকচারে ৯ শতাংশ, চর্মরোগে ৫ শতাংশ, কিডনিজনিত সমস্যায় ৫ শতাংশ, রেস্পিরেটরি ট্রাক ইনফেকশনে ৪ শতাংশ, লিভার সমস্যায় ৩ শতাংশ, পিএলআইডিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ক্যান্সারে ১ দশমিক ৫ শতাংশ ও চোখের সমস্যায় ভুগছেন ১ দশমিক ৫ শতাংশ পুলিশ সদস্য। এছাড়া ১ শতাংশ পুলিশ সদস্য রয়েছেন যারা মানসিক নানা সমস্যায় ভুগছেন। এদের অধিকাংশ রোগের কারণ ‘দীর্ঘ ডিউটি’।

রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডা. এমদাদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুলিশ পেপটিক আলসারে (গ্যাস্ট্রিক) আক্রান্ত। মোট বাহিনীর শতকরা ২০ ভাগ পুলিশ এই রোগে আক্রান্ত। দীর্ঘ ডিউটি এবং অনিয়মিত অনিয়মিত খাদ্যগ্রহণ ও দীর্ঘ সময় অভুক্ত অবস্থায় থাকায় এই রোগ হয়। এছাড়াও দীর্ঘ সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালনের কারণে ধুলা-বালু লেগে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট ও চামড়ার নানা রোগে (স্ক্রিন ডিজিজ) আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা পুলিশের সংখ্যাও অনেক বেশি। এর প্রভাবে পাইলস, হার্ট, কিডনি ও ক্যান্সারের মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।

‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’, বর্তমানে এ স্লোগানের সঙ্গে দেশের অনেক নাগরিকই দ্বিমত পোষণ করেন। তবে পুলিশের দীর্ঘ ডিউটি দেখে ব্যথিত হওয়ার সংখ্যাও কম না। রাজধানী ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তথ্য আদান প্রধান করার ফেসবুক গ্রুপ ‘ট্র্যাফিক অ্যালার্ট’-এ মেহেদী হাসান নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন ‘সকাল ৯ টায় অফিস যাওয়ার সময় গুলশান-১ চত্বরে বাবুল আক্তার নামে একজন ট্রাফিক কনস্টেবলকে দেখে গেলাম। ন্যাম ট্যাগে দেখলাম বাবুল লেখা। বিকেলে সাড়ে ৪টায় বাড়ি ফেরার সময়ও দেখলাম রাস্তায় তিনি। অফিসে যখন গরম লাগে তখন এসি চালিয়ে দেই, ঠাণ্ডা লাগলে এসি থেকে দূরে গিয়ে বসি, জায়গা পরিবর্তন করি। কিন্তু অবাক হলাম, এমন রোদ-বৃষ্টির মৌসুমেও তিনি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। কেন সিগন্যালের পাশেই তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না?

এদিকে, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা থেকে অতিরিক্ত ডিউটি করলেও নির্ধারিত স্কেলেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। নেই ওভারটাইম কিংবা অতিরিক্ত কাজ করার জন্য কোনো ভাতা।

এ বিষয়ে পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস বলেন, বেতনের বাইরে অতিরিক্ত ডিউটির জন্য কোনো টাকা দেয়া হয় না। আমরা চেষ্টা করছি ভাতা বাড়ানোর। কিন্তু এটা শুধু পুলিশের হাতে নয়, এখানে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়াও পুলিশের হেলথ হাইজিনের (স্বাস্থ্যসেবা) নিশ্চিত করতে কিছু করা যায় কি-না এ বিষয়ে ভাবছে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স।

অন্যদিকে, চলতি বছরের ডিসেম্বরে পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) ১০ হাজার জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সাড়ে ৮ হাজার পুরুষ এবং দেড় হাজার নারী সদস্য নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে একসঙ্গে ১০ হাজার জনবল নিয়োগে পুলিশের কাজের চাপ আগের চেয়ে অনেকটা কমে আসবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।