‘যত ব্যায়াম করছি, তত ওজন বাড়ছে, আর কাহাতক সহ্য করা যায় এই যন্ত্রণা’

স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পার্সোনাল ট্রেইনার নিয়োগ করেছেন তসলিমা নাসরিন। জিমের ট্রেইনারের সঙ্গে তার প্রশ্ন-উত্তর সম্পর্কে ফেসবুকে লিখেছেন একটি স্ট্যাটাস। তসলিমা লিখেছেন- ‘যত বেশি জিমে যাচ্ছি, যত ব্যায়াম করছি, তত ওজন বাড়ছে। আর কাহাতক সহ্য করা যায় এই যন্ত্রণা! পারসোনাল ট্রেইনার নিয়ে নিলাম একদিন। যে ট্রেইনারকে দেখে মনে হয়েছে আর সব ট্রেইনার থেকে ভালো, সেই ট্রেইনার। তিন মাসের টাকা একবারে জমা দিয়ে । টাকা জমা হয়ে গেলে ট্রেইনার আমাকে বলল, এই আমার ফোন নম্বর, এটা সেভ করে রাখো। জিজ্ঞেস করলাম, কী নামে সেভ করব? ট্রেইনার বললো, বদিউজ্জামান খান। একটু ঘাবড়ে গেলাম। পরদিন বদিউজ্জামান আমাকে তার খাতায় আমার নাম লিখতে বলল। আমি লিখলাম মানসী রায়। জিমের রেজিস্টারেও এই নাম আমার। যেখানে নিয়মিত যেতে হয়, সেখানের কোথাও নিজের নাম দিই না। নিরাপত্তার জন্যই দিই না। বদিউজ্জামান কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমার পড়া হয়নি। কিন্তু আমার দুজন ক্লায়েন্ট তোমার বই পড়েছে। সেদিন বললো তোমার কথা।’

তার মানে নাম পরিচয় লুকিয়ে কাজ হয়নি। জানে আমি কে।

ব্যায়াম করছি। হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা তুমি কি এই সরকারের সমালোচনা করে কিছু লেখো না?’ লিখি না বললে কপালে কী আছে কে জানে। লম্বা দম নিয়ে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে, বললাম ‘রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সরকারের যে মত, তার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। নিরাশ্রয় মানুষদের আশ্রয় দেওয়া উচিত।’

বদিউজ্জামান খুশি হলো, পরদিন আমাকে বললো, ‘ওয়েসি ভাইরা খুব সুবিধের না। তিন তালাক ব্যাপারটাও ঠিক না। স্ত্রীকে চট জলদি তালাক দিয়ে দিলাম, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সে এখন যাবে কোথায়?’

সম্ভবত সে নেট ঘেঁটে জেনে এসেছে ইদানিং কী নিয়ে বিতর্ক করছি আমি। আমার পক্ষে কিছুটা বলে তারপর জানাল সে মুজাফফরনগরের ছেলে। দিল্লি চলে এসেছে দশ বছর আগে। শহরে ছোটোমোটো একটা বাড়ি করেছে। জীবন বাড়িয়া চলছে। ছেলে ভালো ইস্কুলে পড়ে।

‘তবে কী জানো, এই জিমে ঈদের ছুটি নেই। আমি ঈদে আসি না, সে কারণে আমার টাকা কাটে এরা। কাটুক। তাই বলে ঈদ করবো না?’

‘পুজোয় ছুটি থাকে? ‘

‘হ্যাঁ পুজোয় ছুটি থাকে।’

‘আচ্ছা, মুজাফফরনগরের দাঙ্গায় কজন মুসলমান মরেছিল?’

‘বহুত’।

‘হিন্দুও মরেছিল?’

‘খুব মরেছিল। ইয়ং ছেলেপুলেরা বেশী মরেছিল।’

আমাকে ব্যায়াম দেখিয়ে দেয় বদিউজ্জামান, আমি করতে থাকি। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য আমার সঙ্গে কথা বলা। বলল, ‘এনডিটিভি তো বিজেপি কিনে নিয়েছে। ‘

‘জানি না তো! কবে?’

‘কেনা হয়ে গেছে। এখন এনডিটিভির আশি পারসেন্ট বিজেপির। আমাদের কথা বলার আর কোনও টিভি রইল না। ‘

আমি বললাম, ‘তা কেন হবে, অন্য টিভি তো আছে। বলবে। ‘

‘না, মুসলমানদের ফেভারে আর কোনও টিভি নেই।’

বদিউজ্জামান প্রতিদিন আমার জন্য প্রশ্ন নিয়ে তৈরি থাকে। পরদিন বললো, ‘আচ্ছা এ দেশের হিন্দুরা বলে কোনো মুসলমানই নাকি আগে ছিল না, সব নাকি হিন্দু থেকে এসেছে? এ ব্যাপারে তোমার কী মত? ‘

আমি বললাম, ‘তুমি ইতিহাস জানো না? ভারতের ইতিহাস বা ইসলামের ইতিহাস ? ‘

বদি চুপ।

বললাম, ‘কিছু মুসলমান আরব দেশ থেকে এসেছে, কিছু মধ্য এশিয়া থেকে। আর বাকিরা তো লোকাল লোক, হিন্দু ছিল, মুসলমান হয়েছে। প্রায় সবাই ধর্মান্তরিত মুসলমান। ‘

বদিউজ্জামান বাঁকা হাসলো। বললো,’ ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি হয় বুঝি? পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুসলমান এই ভারতে।’

আমি শুধরে দিয়ে বললাম,’ সবচেয়ে বেশি মুসলমান ইন্দোনেশিয়ায়। দ্বিতীয় ভারতে। ‘

আবারও বাঁকা হাসি, আমার মিথ্যে ধরে ফেলার হাসি। বললো, ‘এত বেশী মুসলমান ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে হতে পারে না।’

আমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ইসলাম আরব দেশ থেকে এসেছে, জানো তো? ইসলামের জন্ম ভারতবর্ষে হয়নি। তবে মুসলমানরা ধর্মান্তরিত, এ কথায় দুঃখ কেন এত? ধর্মান্তরিত তো শুধু মুসলমানই নয়, অন্য ধর্মের মানুষও একসময় কোনও একটা ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে নতুন ধর্মে বিশ্বাস শুরু করেছে। বংশানুক্রমে বিশ্বাস বয়ে চলেছে। হিন্দু, খৃস্টান, ইহুদি,মুসলমান, বাহাই- সবাই আগে অন্য ধর্মে বিশ্বাস করতো।’

আমার কথায় কান দেওয়ার সে প্রয়োজন মনে করলো না। সে ভালো জানে মুসলমানেরা কোত্থেকে এসেছে। সব মুসলমানই হযরত আদমের বংশধর। ধর্মান্তকরণের কোনও ব্যাপার কোথাও ঘটেনি।

আমি জানি না এই ট্রেইনার আমাকে প্রশ্ন করতে করতে কোথায় নেবে।