বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী: সাতক্ষীরায় পত্রদূত সাহিত্য আড্ডায় সুর ও ছন্দের আবেশ

‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’ বাংলা সাহিত্যের অনন্যপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালির রবিঠাকুর এভাবেই স্বাগত জানিয়েছিলেন নতুনকে। তারই দেখানো পথে পঁচিশে বৈশাখ কবির ১৬২তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে সাতক্ষীরায় রবীন্দ্র অনুরাগীরাও এভাবেই স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্বকবিকে।

মঙ্গলবার (৯ মে) সন্ধ্যায় দৈনিক পত্রদূত অফিসে জেলা সাহিত্য পরিষদের আয়োজনে সুর, ছন্দের আবেশে আলোচনায় মেতে উঠেন কবি-সাহিত্যিকরা।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অমিত প্রতিভায় বাঙালির রুচি ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন। সাহিত্যের নানা শাখা থেকে সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও নাটক পর্যন্ত বিচিত্র শিল্পক্ষেত্রকে তাঁর প্রতিভার স্পর্শে অনন্য করে তুলেছিলেন। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করেন।

কাব্য, গীত, কথাসাহিত্য, বাঙালি সত্ত্বা ও সংস্কৃতির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির মনন, চিন্তা ও চেতনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকা নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্ব শিল্প ও সাহিত্যের উজ্জ্বলতম এই নক্ষত্রের জন্মের পর পেরিয়ে গেছে ১৬১ বছর। ক্যালেন্ডারের পাতায় ধুলোর আবরণ। তবু একটুকুও মলিন হয়নি তার কর্ম ও সৃষ্টির আবেদন। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আলো করে জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ। এরপর দেড় শতক ধরে বাঙালির যাপিত জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে জড়িয়ে আছেন তিনি।

কৈশোরে ছড়ার সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে শুরু রবির। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, নৃত্যনাট্য- যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন বলছে আজীবন দু-হাত ভরে লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। এসবের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করে জয় করেছেন নোবেল পুরস্কার। বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছেন গুরুদেব, কবিগুরু, বিশ্বকবি। তবে শুধু সাহিত্যে নয়, সংগীত জগতেও তিনি অনন্য। তার গানের কথা এবং সুর সব কালে সব মানুষের মনের কথাই বলে যায়।

কবিগুরুর ১৬২তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রবীন্দ্রানুরাগী প্রফেসর মো. আবদুল হামিদ।

প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাতক্ষীরা জেলা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বরেণ্য সংগীত শিল্পী শহীদুর রহমান।

বক্তব্য রাখেন দৈনিক পত্রদূতের উপদেষ্টা সম্পাদক নাগরিক নেতা ও সংস্কৃতিজন আবুল কালাম আজাদ, প্রফেসর ইদ্রিস আলী, দৈনিক পত্রদূতের বার্তা সম্পাদক এসএম শহীদুল ইসলাম, বরেণ্য সাংবাদিক ও কবি আবুল কাশেম, জেলা সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ম. জামান, কবি নিশিকান্ত ব্যানার্জী, বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও সাহিত্যিক মনিরুজ্জামন, কবি আবু ছালেক (কালাচান কবি), কবি রুবেল, নাসরিন নাজরানা বেবি প্রমুখ।

সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ও কাব্যিক আলোচনা করেন দৈনিক পত্রদূতের সহকারী সম্পাদক (সাহিত্য) কবি সৌহার্দ সিরাজ।

অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর আব্দুল রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করেন।

এসময় তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাঙালির প্রেরণাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অমৃতসন্তান। তার গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের প্রেরণাশক্তি। তার গান, সাহিত্য ও কর্মচেতনা বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। পাকিস্তানবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে রবীন্দ্রসাহিত্য ছিল আমাদের প্রধান অবলম্বন।

প্রধান আলোচক বরেণ্য সংগীত শিল্পী শহীদুর রহমান বলেন, বাঙালির অস্তিত্ব ও চেতনার সঙ্গে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল সাহস ও প্রেরণার উৎস। শাশ্বত বাংলার মানুষের দু:খ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা অর্থাৎ সব অনুভব বিশ্বস্ততার সঙ্গে উঠে এসেছে রবীন্দ্রসাহিত্যে।

আলোচক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও তার সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে। বাঙালির সংকটে, সংগ্রামে, আনন্দে, বেদনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছে। ইতিহাসের নানা বাঁকে নতুন ব্যঞ্জনায় তাঁর সৃষ্টি সমকালের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁর চিত্তকে শৈশব থেকেই গড়ে তুলেছিল। জমিদারির কাজে পূর্ব বাংলার নদীপথ, নিসর্গ ও গ্রামীণ জীবনযাত্রা তাঁর মন চিরদিনের জন্য বদলে দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে কেবল প্রেরণাই দেননি, নিজেও সোচ্চার হয়েছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ শাসকদের নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতিবাদে বর্জন করেছিলেন তাদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি। তাঁর দীর্ঘ ৮০ বছরের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটেছিল ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের বাইশে শ্রাবণ।

প্রফেসর ইদ্রিস আলী বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও তাঁর সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে। মৌলবাদের উত্থান, জাতীয়তাবোধের সংকীর্ণতা, শ্রেণিবৈষম্য, হানাহানি-এসবের কারণে বর্তমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্র আদর্শকে মনে-প্রাণে ধারণ করতে পারলে পৃথিবী হবে শান্তিময়।

বক্তারা দৈনিক পত্রদূতের পৃষ্টপোষকতায় সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে জেলার সর্বত্র রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, সিকান্দার আবু জাফরসহ বরেণ্য কবিগণের জীবন-আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।