এপ্রিল ফুল : বিজাতীয় সংস্কৃতি || আবদুল হাই ইদ্রিছী

আবদুল হাই ইদ্রিছী : তখন আমি এইচএসসি’র ছাত্র। সকাল ৭টা। চা-নাস্তা খেয়ে পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে চোখ বুলাচ্ছি। এরই মধ্যে আমার এক আগমন। রুমে ঢুকেই হাতে একটি হলদে খাম ধরিয়ে দিয়ে বললো- এটি রাখ ৫মিনিট পর খুলবে। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। আমি মনে টান টান উত্তেজনা নিয়ে বসে রইলাম। কারণ সে বলে গেছে ৫মিনিট পরে খুলতে। ৫মিনিট যেন আমার জন্য ৫বছরের সমান মনে হচ্ছে। কি আছে এতে? নির্দিষ্ট সময় পর খুললাম- একি! কিচ্ছু নেই! ফাঁকা খাম! দারূন রাগ হলো আমার। কিছুক্ষন পর সে আবার এলো। আমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে হো হো হেসে উঠলো এবং বললো- ”আজ ১লা এপ্রিল, তাই তোকে বোকা বানিয়ে মজা করলাম।” তুই কি জানিস না আজ এপ্রিল ফুল- মানে ”এপ্রিলের বোকা দিবস”। হায়রে মুসলমান! এই বুঝি মুসলিম সংস্কৃতি!

প্রায় ৫৫০ বছর পূর্বের কথা। স্পেনের অত্যাচারী রাজা রডরিকের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মুসলমান বীর তারিক বিন জিহাদ মাত্র ৭০০ সৈন্য নিয়ে রডরিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রডরিকের লক্ষাধিক সৈন্যকে পরাজিত করে মুসলিম সভ্যতার গোড়া পত্তন করেন। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পরবর্তী ৮০০ বছর মুসলমানরা আধিপত্য বিস্তার করে। মুসলমানদের নিরলস প্রচেষ্টায় এই ৮০০ বছরে স্পেনে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে। যার সাক্ষি হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গ্রানাডা, আলহামরা, টলোডো প্রভৃতি। কিন্তু এই ৮০০ বছরের শেষের দিকে যখন মুসলমানরা ভ’লে গেল তাদের অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, মত্ত হয়ে গেল ভোগবিলাসে, জড়িয়ে পড়লো লোভ লালসায়, সরে গেল কোরআর সুন্নার আদর্শ থেকে তখন তারা আটকে যায় খিষ্টানদের কূটনৈতিক চক্রান্তে। খিষ্টানদের চোখে ধরা পরে মুসলমানদের মুসমানদের অনৈক্য ও দুর্বলতা। ফলে মুসলিম বিদ্ধেষী নরপিশাচ রাজা ফার্দিনান্দ ভাবলো ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে গিরজীয় পর্বতমালা অতিক্রমকারী সম্প্রদায়কে যদি উচ্ছেদ করা না যায় তাহলে রাজত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। বরং গীর্জা থেকে তাদের আজানের ধ্বণী শুনা যাবে। এটা ফার্দিনান্দের জন্য মেনে নেয়া ছিল বড়ই কষ্টকর। তাই ফার্দিনান্দ মুসলিম নিধনের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এবং একাজে উৎসাহী পার্শ্ববর্তী পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলাকে বিয়ে করে উভয় মিলে একটি যৌথবাহিনী গঠন করে গ্রানাডা দখলের জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। তারা যখন তাদের প্রন্থুতি সম্পন্নে ব্যস্ত তখন কতিপয় নামধারী স্বার্থাম্বেষী মুসলমান তাদের আশ্রয় দিলে তারা হঠাৎ মুসলমানদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।

হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে অবরোধ করে রাজধানী গ্রানাডা। তখন মুসলমানদের টনক নড়ে। তারা রুখে দাঁড়ায়। ফার্দিনান্দ বুঝতে পারে সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের সাথে আর পারা যাবেনা, তাই সে অন্য পথ অবলম্বন করে। তারা ফসলের ক্ষেত, খাদ্যগুদাম, শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র এবং ভেলা উপত্যকা ইত্যাদি জ্বালিয়ে দেয়। ফলে অচিরেই স্পেনে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কালো থাবায় যখন মুসলমানরা দিশেহারা তখন যৌথবাহিনী মুসলমানদের অবরোধ করে। এই সুযোগে প্রতারক ফার্দিনান্দ তার যৌথবাহিনীকে গ্রানাডার বিভিন্ন মসজিদের পার্শে সশস্ত্র অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেয়। প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ফর্দিনান্দ ঘোষণা করে মুসলমানরা যদি অস্ত্র সমর্পন পূর্বক মসজিদে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদেরকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেয়া হবে। আর যে সকল মুসলমান সমূদ্রে খিষ্টান জাহাজ সমূহে আশ্রয় নেবে তাদেরকে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রে পৌছে দেয়া হবে। ফার্দিনান্দের এঘোষনায় বিশ্বাস করে ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল মুসলমানরা সেই ভাবে আশ্রয় নিলে প্রতারক ফার্দিনান্দের সম্মিলিত বাহিনী সকল মসজিদে তালা লাগিয়ে আবদ্ধ করে মসজিদে আশ্রয়রত মজলুম মুসলমানদের আগুনে পুড়িয়ে এবং জাহাজে আশ্রয়রত মুসলমানদের মহাসমূদ্রে ডুবিয়ে মারে। সব মিলিয়ে সেদিন শাহাদাত বরণ করেছিল প্রায় প্রায় ৭লক্ষ মুসলমান। সেই অসহায় শান্তি প্রিয় প্রতারিত মুসলমানদের আতœচিৎকারে আকাশ-বাতাস যখন ভারি হয়ে উঠেছিল তখন নরপিচাশ ফার্দিনান্দ স্ত্রী ইসাবেলাকে আনন্দে বলতে থাকে হায় মুসলমান! তোমরা এতো বোকা! আর ইসাবেলা উচ্চারন করে – ”হায় এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাসে কেউ বিশ্বাস করে!” সেই দিনই ইসাবেলা মুসলমানদের নাম দেয় ”এপ্রিল ফুল” (অঢ়ৎরষ ঋড়ড়ষ) অর্থাৎ এপ্রিলের বোকা।

ইতিহাসের অন্যতম নরপিচাশ ফার্দিনান্দ সেদিন মুসলমানদের সাথে যে ধোঁকাবাজি করেছিল, সৃষ্টি করেছিল মর্মান্তিক ইতিহাস, উন্মত্ত করেছিল মানবতার কবর রচনায়, সে দিনটি স্বরণ করার জন্য ধোঁকাবাজ খিষ্টানরা আজও প্রতি বছর ১লা এপ্রিল পালন করে- ”এপ্রিল ফুল’স ডে”। দুঃখজনক হলেও সত্য আজ আমাদের মাঝেও প্রবেশ করেছে খিষ্টানদের সংস্কৃতি, লেগেছে তথাকথিত আধুনিকতার কালো ছোঁয়া, আমরা ভ’লে যাচ্ছি নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। যুগের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে মুসলমানদের মধ্যেও মিজানের মতো অনেকে পালন করে ”এপ্রিল ফুল’স ডে”। এটাই নাকি আধুনিকতা! আমরা এতই হীন, বিবেকহীন! নিজেদের সাথে নিজেরাই প্রতারনা করছি!

১৯৯৩ সালের ১লা এপ্রিল গ্রানাডা ট্রাজেডির ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক সভায় মিলিত হয়ে বিশ্ব খিষ্টান সম্প্রদায় বিশ্বের মুসলিম জাগরনকে প্রতিহত করার জন্য গড়ে তোলে ”হলি মেরি ফান্ড”। তারা সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বে খ্রিষ্টানরাই আধিপত্য বিস্তার করবে। তাদের সেই সিদ্ধান্ত তারা আজ বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় একটির পর একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে ধ্বংস করছে।

শুধু গ্রানাডা ট্রাজেডিই নয় বরং যুগে যুগে সর্বদাই খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের অভ্যন্তরীন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মুসলমানদের ধ্বংস সাধন করে আসছে। আজও করছে। প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তেই করছে। তারা সংস্কৃতির নামে চালাচ্ছে অপসংস্কৃতির প্রসার। আধুনিকতার নামে ধ্বংস করছে মুসলমানদের ঈমান। বিশ্বময় আধিপত্য বিস্তারের জঘন্য খেলায় মেতে ওঠা এই আন্তরর্জাতিক খুনীচক্রের কারনে পৃথিবীর আজ বড়ই দুর্দিন। এক্ষুনি মুসলমানদের সচেতন হবার প্রয়োজন। অন্যতায় অচিরেই গ্রানাডার মত মধ্যভ’মিতে পরিনত হবে পৃথিবী। তাই আজ সময়ের দাবী হিসেবে উচিত সমগ্রহ বিশ্ব মুসলিম এক হয়ে ১লা এপ্রিলের শোককে শক্তিতে পরিনত করে ওদের সকল চক্রান্তকে প্রতিহত করা।

লেখক :

আবদুল হাই ইদ্রিছী : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কবি। সম্পাদক: মাসিক শব্দচর