‘দুই প্রেসিডেন্ট’ নিয়ে কী ঘটছে ভেনেজুয়েলায়

ভেনেজুয়েলায় জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকেই ব্যাপকভাবে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। একদিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়ে নিজেকে বৈধ দাবি করছেন, অন্যদিকে বিরোধী দলীয় নেতা তাকে অবৈধ উল্লেখ করে নিজেকেই অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে বসে আছেন।

আর এ ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি পক্ষগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপ যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। বিরোধী দলের নেতা হুয়ান গুইদোকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো।

তবে রাশিয়া, চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ নিকোলাস মাদুরোর প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়ে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছে।

নেতৃত্ব নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখেও এরই মধ্যে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, তিনি দাবি করেছেন গত নির্বাচনে তার বিজয় একেবারেই বৈধ ছিল।

তবে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর গত সপ্তাহে বিরোধী দলীয় নেতা হুয়ান গুইদো নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। যার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে টানাপোড়েন চরম পর্যায়ে চলে যায়।

এ বিষয়ে রুশ সংবাদ সংস্থা ‘রিয়া’কে এক সাক্ষাৎকারে মাদুরো জানিয়েছেন বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত তিনি।

‘আমি ভেনেজুয়েলার মঙ্গলের জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি,’ বলেন তিনি।

ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে মাদুরো জানান, বৈধ নির্বাচনের পরও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পক্ষ যদি নতুন করে নির্বাচন চায় তাহলে তাদেরকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে তিনি এ-ও বলেন, ভালো রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হিসেবে যথাসময়ের আগেই পার্লামেন্টারি নির্বাচনের আলোচনাকে সমর্থন করেন তিনি।

কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের আল্টিমেটাম বা ব্ল্যাকমেইলিং সহ্য করতে তিনি রাজি নন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট মাদুরো বলেন, তার পক্ষে রয়েছে ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনী।

সেনাবাহিনী ত্যাগ করে চলে যাওয়া সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোর চক্রান্ত করছে বলেও অভিযোগ করেন মাদুরো।

নিকোলাস মাদুরো

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে যাওয়ারা কলম্বিয়ান প্রশাসনের ভাড়াটে সেনায় পরিণত হয়েছে। তারা কলম্বিয়ায় থেকেই ভেনেজুয়েলার সশস্ত্র বাহিনীকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি।

গুইদোর আহ্বানে নতুন দফায় বুধ ও শনিবার বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এ সাক্ষাৎকার দেন মাদুরো।

বিরোধী দলীয় নেতা হুয়ান গুইদো একই সঙ্গে ভেনেজুয়েলার পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র প্রধান। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অবৈধ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেছেন, ভেনেজুয়েলার সংবিধান অনুসারে কোনো প্রেসিডেন্ট যদি অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হন, তবে এমন পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট প্রধান সাময়িকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন।

এই আইন অনুসারে সংবিধান বর্তমান পরিস্থিতিতে তাকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে বলে দাবি করেছেন গুইদো।

নির্বাচনের পর চলতি মাসের শুরুর দিকে মাদুরো দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। বিরোধী দলের আন্দোলন নির্বাচনের আগে থেকে চললেও শপথের পর থেকে তা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রূপ নেয়।

ভেনেজুয়েলার এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগে নির্বাচন বয়কটও করেছে বিরোধী দল।

বিশ্ব যেভাবে দেখছে ভেনেজুয়েলা সংকট

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ ২১ টিরও বেশি দেশ হুয়ান গুইদোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। গুইদোকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে দেশগুলোর সরকার।

বুধবার এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউজ জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পথকে সমর্থন জানানোর জন্য গুইদোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখবেন।

এর পাল্টা পদক্ষেপও নিয়েছেন মাদুরো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। দেশটির কূটনীতিকদের ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে ভেনেজুয়েলা ছাড়ার নির্দেশও দেয়া হয়।

এরই মধ্যে ভেনেজুয়েলার সুপ্রিম কোর্ট গুইদোর বিদেশ সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। একই সঙ্গে তার সবগুলো ব্যাংক একাউন্টও জব্দ করা হয়েছে।

অন্যদিকে নিকোলাস মাদুরোর পক্ষে আছে রাশিয়া চীন মেক্সিকো এবং তুরস্ক। তবে মাদুরোর সুরক্ষায় রাশিয়া থেকে ভেনেজুয়েলায় ভাড়াটে সেনা পাঠানো হয়েছে, এমন কথা শোনা গেলেও তা অস্বীকার করেছেন রুশ কর্মকর্তারা।

ইতোমধ্যে গত সোমবার ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান পিডিভিএসএ’র ওপর অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনীর প্রতি যুক্তরাষ্ট্র শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।

এই অবরোধ আরোপ করে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন বলেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এবং তার সমর্থকরা এখন থেকে আর ভেনেজুয়েলার জনগণের সম্পদ লুট করতে পারবেন না। তারই একটি চেষ্টা হিসেবে এই অবরোধ।

তবে গুইদোকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিলে এই অবরোধ তুলে নেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

এর আগে রোববার এক টুইটবার্তায় জন বোল্টন বলেছিলেন, কোনো মার্কিন কূটনীতিক ও ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলীয় নেতা হুয়ান গুইদোকে হুমকি দিলে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের হুমকি আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক অবমাননা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভেনেজুয়েলা তারা তেলের ব্যবসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দেশটির মোট তেল রপ্তানির ৪১ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। আর এ কারণেই এই তেলের খাতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল যুক্তরাষ্ট্র।