৪০ বছর পর মা-ছেলের প্রথম সাক্ষাৎ!

মাথার উপর খোলা আকাশ। মুক্ত হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারা। কত বছর পর! না না, কত যুগ পর! এই অবস্থায় ৪০ বছরের ছেলেকে প্রথম বার সামনে পেয়ে মা তাকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলেন।

পেনসিলভানিয়ার অল্প দূরে ছোট্ট পল্লী, ক্লিফটন হাইটসের সুপার মার্কেটের লোকজন তাদের অবাক হয়ে দেখছিলেন। তারা তো আর জানেন না যে, এই ভাবে মা-ছেলে দু’জন দু’জনকে পেলেন কতগুলো দশক পর। মা আবেগ ভেসে যাওয়া ওই মুহূর্তের বর্ণনা বলছেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সত্যিই এটা ঘটছে তো? আমি শুধু ছেলেকে বার বার জড়িয়ে ধরে আদর করছিলাম।

এত বছর পর ছেলেকে বুকে পেয়ে সব মায়ের তো সেই কথাটাই মনে হয়: ‘আয় ফিরে সগৌরবে…মাতৃ-অঙ্কে মম লহো আপনার স্থান।’ ছেলের মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে যে কোনও ছেলের অনুভূতি এই রকমই: ‘সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী/তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে/রাখো ক্ষণকাল।’

মা ডেবি আফ্রিকা ছিলেন জেলে। আমেরিকায় কৃষ্ণকায়দের অধিকারের দাবিতে হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে তার কঠিন সাজা হয়েছিল। তবে প্যারোলে মুক্তির সিদ্ধান্ত যারা নেয়, সেই পর্ষদ মনে করেছে, সমাজের পক্ষে ডেবি আর বিপদ নন।

সম্প্রতি ক্যামব্রিজ স্প্রিংস প্রিজন মুক্তি দেওয়া হয়েছে ওই নারীকে। মা এখন আছেন ছেলে মাইকের কাছে। মাইক জুনিয়র। ডেবির স্বামী, তার সন্তানের বাবার নামও মাইক। মাইক সিনিয়র। তিনি অবশ্য এখনও জেলে। বর্তমানে আছেন গ্রেটারফোর্ড সংশোধনাগারে। আমেরিকায় তিনিও কৃষ্ণকায়দের অধিকার নিয়ে শুরু হওয়া হিংসাত্মক বিপ্লবী আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন।

একে অন্যের কাছাকাছি আসার পর মা ডেবি ও ছেলে মাইকের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না। ক্লিনটফ হাইটসে নিজের বাড়িতে মা-কে রেখেছেন মাইক। ডেবি বাড়ি আসার পর প্রথম সকালে প্রাতঃরাশের সময়ে মা ও ছেলে দু’জনই ছিলেন খালি পায়ে।

মাইক বলছেন, আমার মায়ের পা জোড়া কী রকম, সেটা এর আগে আমার দেখার সুযোগ কখনও হয়নি। জেলে যখন দেখা করতে যেতাম, তখন পা দেখার কোনও সুযোগ থাকত না। মা আমার পা এর আগে শেষ দেখেছে তখন, আমি যখন তিন দিনের শিশু।

সেই সময়ে নিজের কাছ থেকে সন্তানকে সরিয়ে দেন ডেবি। তার কথায়, খুব, খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমাকে। তবু ছেলের যেটা ভালো হবে, আমি সেটা চেয়েই ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার কাছে থাকলে সেটা কোনও ভাবেই হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই, ওই বন্ধন ছিন্ন করেছিলাম।

মাইক বড় হয়েছিলেন তার ঠাকুমার কাছে। পরে ‘মুভ’ নামে একটি সংস্থার নারী সদস্যেরাও তাকে কোলেপিঠে মানুষ করেন।

মাইক বলেন, সমাজ আমাকে মানুষ করেছে। জন্ম দেয়া মায়ের কাছ থেকে আমাকে দূরে থাকতে হয়েছে। তবে আমি একাধিক মা’কে পেয়েছিলাম।

প্রত্যেক মাদার্স ডে-তে গ্রিটিংস কার্ড ও ফুলের তোড়া দিতে মাইক যান তার ছ’জন মায়ের বাড়িতে। সেই মায়েদের নাম: বার্ট, সু, রোমানা, প্যাম, মেরি, টেরেজা। এবার মাইক তার জন্মদাত্রীকে মাদার্স ডে-র উপহার দিতে পারবেন।

ছয়/সাত বছর বয়স পর্যন্ত বালক মাইক জানত না, কারা তার মা-বাবা। তার কথায়, আমি জানতাম না, আমার মা জেলে বন্দি। আমি ভাবতাম, যে নারী আমাকে বড় করে তুলছেন, তিনিই আমার মা। তার ছোটবেলাটা অন্য শিশুদের চেয়ে অন্য রকম ছিল বলে মাইক জানাচ্ছেন।

তিনি বলেন, কোনও বাচ্চাকে তার মা-বাবা ছাড়া অন্য কে ঠিক ভাবে দাঁত মাজা, স্নান করা শেখাতে পারে? ১৫ বছর পর্যন্ত আমি জানতাম না, মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে কীভাবে চুল পরিষ্কার রাখতে হয়।

মাইকের শৈশবে তাকে বছরে এক বা দু’বার তার মা-বাবার সঙ্গে জেলে দেখা করাতে নিয়ে যাওয়া হতো। দু’জন আলাদা সংশোধনাগারে বন্দি ছিলেন। বহু বছর পর্যন্ত মাইক জানতেন না, তার বাবা-মা কেন কারান্তরালে। যখন স্কুলের বন্ধুরা যখন তাকে তাদের কথা জিজ্ঞাসা করতো, তখন বানিয়ে কিছু বলতে হত মাইককে।

তবে এখন মা ও ছেলে দু’জনেই অতীতের ক্ষত নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চান না। ডেবি আফ্রিকা বলেন, আমার জীবনে এমন অনেক কিছু হয়েছে, যা আমি চাইনি। আমার ছেলেকে যে ভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে বড় হতে হয়েছে, সেটাও আমার কাছে অনভিপ্রেত। কিন্তু এখন আমার ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ হয়েছে। এটাই আমার সব চেয়ে ভালো লাগা।

ছোট একটি ব্যবসা আছে মাইক জুনিয়রের। তিনি বাগান তৈরি করেন। তার বাড়িতে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই, তার ওটা দরকারও নেই। মাইক বিয়ে করেছেন, এখন তিনি চার সন্তানের বাবা। তার ঘরে সুখ আছে, আলোও প্রচুর।

মা চলে এসেছেন। এবার মাইক জুনিয়র চান, তার বাবা মাইক সিনিয়রের প্যারোলে মুক্তি। যাতে তাদের পরিবার পূর্ণাঙ্গ হয়। মাইক সিনিয়র ও ডেবি দু’জন দু’জনকে রক্তমাংসের চেহারায় শেষ দেখেন ১৯৮৬ সালে। মা-বাবার পুনর্মিলন চান মাইক জুনিয়র। চান বাবাকে কাছে পেতে। মাইক সিনিয়রের মুক্তির আবেদন নিয়ে প্যারোল বোর্ডের পরবর্তী শুনানি সেপ্টেম্বরে।