আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম কুরবানি

মোঃ সোলায়মান আলী : কুরবানি ঈমানদারদের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদাতের নাম। কুরবানি অর্থ হচ্ছে নৈকট্য লাভ করা, ত্যাগ স্বীকার করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। শরিয়তের ভাষায়-নিদিষ্ট দিনে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ ও ইবাদাতের জন্য হালাল পশুকে জবাই করাকে কুরবানি বলা হয়। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবীগণ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই কুরবানি কি? রাসূল জওয়াবে বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নাত। আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ এতে আমাদের কি? রাসূল (সা.) বললেন, প্রতিটি লোমের পরিবর্তেও একটি করে নেকি রয়েছে।

কুরবানির ইতিহাস: বর্তমান কুরবানি হযরত ইবরাহিম (আ.) কে তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানি করার পরীক্ষা থেকে হয়ে থাকলেও প্রত্যেক যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালার মনোনিত শরীয়তে কুরবানির বিধান ছিল, এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছিলাম” (সুরা হজ্জ: ৩৪)। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কুরবানি করেছিলেন হযরত আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল এবং কাবিল। কোরআন শরীফে ঘটনাবলি এভাবে পাওয়া যায় যে, “আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি হলো এবং অন্যজনের হলো না। তাদের একজন বলল, (কাবিল) আমি তোমাকে হত্যা করবো। অপরজন বললো (হাবিল), আল্লাহতো মুত্তাক্বীদের কুরবানী কবূল করে থাকেন। (সূরা মায়েদা ২০)।

হযরত আদম (আ.) এর শরীয়ত মোতাবেক, একই গর্ভ থেকে যে, পুত্র ও কন্যা জন্ম নিবে তারা ভাই বোন বলে গন্য হবে এবং তাদের মধ্যে বিয়ে হারাম। ঘটনাক্রমে, কাবিলের সাথে জন্ম নেয়া বোনটি সুন্দরী এবং হাবিলের সাথে জন্ম নেয়া বোনটি কুশ্রী। বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী কাবিলের সাথে বিয়ে ঠিক হয় হাবিলের সাথে জন্ম নেয়া মেয়েটি। কাবিলে এ নিয়ম প্রত্যাখ্যান করে তার সাথে জন্ম নেয়া সহজাত বোনকেই তার সাথে বিয়ে দেয়ার দাবি করে। আদম (আ.) কাবিলের আবদার ফিরিয়ে দিলেন এবং হাবিল এবং কাবিলের মতভেদ দূর করার জন্য বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্যে নিজ নিজ কুরবানি পেশ কর। যায় কুরবানি কবুল হবে তার সাথেই সুন্দরী কন্যার বিবাহ দেয়া হবে। দুইজন নিজ নিজ কুরবানি পেশ করল, আল্লাহ হাবিলের কুরবানি কবুল করায় কাবিলের আরো ক্ষোভ বেড়ে গেল। কাবিল তার ভাইকে হত্যা করলো। মূলত এ থেকে কুরবানি ইতিহাসের গোড়াপত্তন।

পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত অসংখ্য নবী রসূলকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন হতে হয়েছে এবং পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে আল্লাহ তায়লার সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত ইবরাহিম (আ.) ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানির পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের পরিচয় দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছিলেন। ইবরাহিম (আ.) এর কুরবানি প্রসংগে আল্লাহ সুবানাহু তায়ালা কুরআনে ইরশাদ করেন- “দুইজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহিম (আ.) তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্য প্রমানিত করে দেখালে। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি অবশ্য এই ছিল আমার সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে পুত্রকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাকে পরর্বীদের মাঝে স্মরনীয় করে রাখলাম।” (সুরা সফ্ফাত- ১০৩- ১০৮)

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে অন্যত্র এরশাদ করেন, “যখন ইবরাহিম (আ.) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।” (সুরা বাকারাহ্: ১২৪)

উদ্দেশ্য: আল্লাহর নির্দেশ পালন করে বনের পশুকে জবাই করার সাথে সাথে নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা কু-প্রবৃত্তিকে জবাই করা এবং জবাইকৃত পশুর গোশত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরিব-মিসকিনদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা এবং নিজে খাওয়া।

ইবরাহিম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানির যে পরীক্ষা দিয়েছেন, তা থেকে আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় আলোকিত করতে হবে। সকল সমস্যায় ধর্য্য ধারণ এবং দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই কুরবানির মৌলিক শিক্ষা।

কুরবানি আরো শিক্ষা দেয় যে, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে। কুরবানির পশুর গলায় ছুরি চালানোর সাথে সাথে গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, পরনীন্দাসহ সকল প্রকার পশুসূলভ আচরনের উপর ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শরীয়তের নিয়ম কানুন, প্রতিটি আদেশ, নিষেধ ও আনুগত্য করতে হবে তবেই এই কুরবানি হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম।