ইসরায়েল-ভারত সম্পর্ক : একটি স্বর্গীয় বিয়ের আদ্যোপান্ত

চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন দুই দেশের সম্পর্ক একটি স্বর্গীয় বিয়ের মতো। কিন্তু পাকিস্তানের সিনেটের চেয়ারম্যান রাজা রব্বানি সম্প্রতি তেহরানে বলেছেন, এটি একটি ইউনিয়নের চেয়েও বেশি কিছু; যা নরকে গর্ভবতী হয়েছে।

তিনি মুসলিম বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ভারতের উদীয়মান সম্পর্ক মুসলিম উম্মাহর জন্য বড় ধরনের এক হুমকি।’ রব্বানি বিষয়টি যদি স্পষ্ট করে বলতেন তাহলে এই জোটে সৌদি আরবকেও অন্তর্ভূক্ত করতেন।

কথা বলার ধরন এবং কাজে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণায় সৌদি আরব বেশ শান্ত মাথায় ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করেছেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এর মাধ্যমে সৌদি আরবের সহানুভূতি প্রকাশ যে মিথ্যা তা পরিষ্কার হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা করছে ভারত এবং ইহুদিবাদী এ রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার ইসরায়েলি পর্যটক ভারতে ঘুরতে যায়। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতে অস্ত্র সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর তৃতীয় স্থানে আছে ইসরায়েল। কিন্তু অতীতে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসার সম্পর্ক রেখে ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান ধরে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।

নেতানিয়াহুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও তার সফরের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিক্ষোভ দেখা না যাওয়ায় এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, ভারতে জনমতের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এবং অবশ্যই দুই দেশের স্বার্থের মধ্যে এককেন্দ্রীক সম্পর্ক আছে। ইসরায়েল বিপুল পরিমাণে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি এবং রফতানি করে। গত বছর দেশটি রেকর্ড সাড়ে ছয়শ কোটি ডলারের অস্ত্র রফতানি করেছে।

সাম্প্রতিক সফরে নেতানিয়াহু ভারতের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী ট্যাংক সংক্রান্ত একটি সম্ভাব্য চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করেছে। এর আগে ইসরায়েলের এই প্রস্তাব স্থগিত করা হয়েছিল; কারণ ভারত স্থানীয়ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও নির্মাণের কথা ভাবছে। শুষ্ক অঞ্চলের কৃষি খাতে ইসরায়েলের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা ভারতীয় পরিস্থিতির সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীকে প্রশিক্ষণের প্রস্তাবও দিয়েছে ইসরায়েল।

সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটে যখন ভারতের যোগ দিচ্ছে তখন পাকিস্তানের সিনেট চেয়ারমান রাজা রব্বানির মন্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, তেল আবিবের পক্ষ অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখার লক্ষ্যেই কাজ করছে সৌদি অরব।

ইরানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিলেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। একই সঙ্গে তিনি সৌদির ক্ষমতাসীন রাজ-পরিবারকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। পূর্বসুরীর নীতি থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়ে অন্য লেভেলে নিয়ে গেছেন।

যা দ্রুতই জাতিসংঘসহ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের বোঝাপড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। এটা সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের কানে সংগীতের মতো বাজছে; যারা প্রতিনিয়ত চাচ্ছেন, তেহরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক ওয়াশিংটন।

ট্রাম্পের পাকিস্তানবিরোধী টুইট ঝড়ে যে পাকিস্তানিরা এই বলে নিজেদের সান্ত্বনা দিয়েছেন যে, ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চীন এবং সৌদি আরব আমাদের রক্ষা করবে; তাদের ঘুম ভেঙে কফির ঘ্রাণ নেয়া উচিত। সৌদি আরব প্রকাশ্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রপন্থী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভারত ঘনিষ্ঠ হবে। আর এতে ভারতের লাভ হলেও পাকিস্তানের থলেতে কিছুই জুটবে না; বরং বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেবে।

অপরদিকে ভারতকে নিরপেক্ষ করার চেষ্টা করে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে চীন। তবে এটি ব্ল্যাংক চেকের মতো কোনো ইস্যু নয়। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এটি আর একটি ইন্দো-পাক দ্বন্দ্বে রূপ নেবে না।

কূটনীতির একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে; প্রতিকূল শক্তিগুলোকে দলবদ্ধ হওয়া থেকে বিরত রাখা এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য প্রতিরক্ষামূলক জোটগুলোতে অংশ নেয়া। পাকিস্তানি কলামিস্ট ইরফান হুসাইন দেশটির জাতীয় দৈনিক ডননিউজে লেখা এক নিবন্ধে বলেছেন, এই মাপকাঠিতে আমরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছি। আমাদের একমাত্র কাশ্মির ইস্যুতেও আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছি।

এর একটি কারণ হচ্ছে, অবশ্যই ভারত এখন বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান খেলোয়াড় হওয়া ছাড়াও প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিপরীতে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী জিহাদি ও তাদের মতাদর্শের রফতানিকারক হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে। হাফিজ সাইদকে ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাই হামলার মূল হোতা হিসেবে দেখা হলেও ১০ বছর পরও তিনি মুক্ত আছেন। ইসলামাবাদকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে তুলে ধরতে হাফিজ সাইদের এই সংশ্লিষ্টতাও নেতিবাচক অবদান রেখেছে। (ডন থেকে সংক্ষেপিত)।