ঈদে মিলাদুন্নবী: বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মহানবী (সা:)

মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির পূর্ণতার পরম উৎকর্ষ সাধনের জন্য সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা:)কে পৃথিবীতে পাঠান পবিত্র ১২ই রবিউল আউয়ালে। রবিউল আউয়াল মাস মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, কারণ এটি রাসুল (সা:) এর জন্মগ্রহণ মাস। বিশ্ব নবীর শুভাগমনে ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে। মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামের পূর্ণতা দানের জন্যই মহানবী (সা:) এর আবির্ভাব।

আরবি ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ বা খুশি। আর ‘মিলাদুন্নবী’ অর্থ নবীর (সঃ)-এর জন্ম। অর্থাৎ মহানবীর (সঃ) জন্মদিনের আনন্দোৎসবের নামই ঈদে মিলাদুন্নবী। ১২ই রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ)। সকল ঈদের চেয়েও উত্তম ঈদ হলো ঈদে মিলাদুন্নবী। দয়াল নবীর শুভাগমনের দিন বা মিলাদের দিন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঈদ বা খুশির ও আনন্দের দিন।

৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট ১২ই রবিউল আওয়াল রোজ সোমবার হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পবিত্র মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুন, ১২ই রবিউল আওয়াল ১১ হিজরী একই দিনে (সোমবার) ৬৩ বৎসর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। ১২ রবিউল আওয়াল যেই দিন ও যেই মুহুর্তে মহানবী (সঃ)-এর ধুলির ধরায় আগমণ করেন, সেই দিন ও সেই মূহুর্তটি বিশ্বজগতের জন্য মহানন্দের দিন। কেননা তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও মহামানব।

তিনি বিশ্বমানবতার প্রতীক ও সত্য সুন্দরের বানী বাহক। তাঁর পরশ পাথরে যাযাবর বর্বর আরবজাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিনত হয়। তিনি উৎপীড়িত নির্যাতিত মানুষসহ সকল শ্রেণীর মানুষের ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে হেরা গুহায় নবুয়ত লাভের পর তিনি ইসলামের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মক্কাবাসীর অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন।

তাঁর তাওহীদের বাণী প্রচারে আরব জাহানে নবজাগরণ স ারিত হয়, নতুন সভ্যতা- সংস্কৃতির উন্মেষ ও আবির্ভাব ঘটে এক নতুন জীবন ব্যবস্থার। অচিরেই নতুন সভ্যতা, ঐক্য, শান্তি, সাম্য ও মানবকল্যানের চিন্তা- চেতনা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সার্বিক চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত করে। নবুয়ত প্রাপ্তির মাত্র ২৩ বৎসরের ব্যবধানে এত বড় অভাবনীয় সাফল্য আর কোন নবী রসুল বা মহাপুরুষ অর্জন করতে পারেননি।

নবী রাসুলগণ মানবী ও মানবতাবাদী। তাঁরা জ্ঞানের ধারক ও বাহক। তাঁদের কাছে মানবতা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। মানবকল্যানের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক হলো আল-কোরান। আল-কোরান গুণবাচক নামের তাৎপর্য। কোরান বিশ্ববাসীর ও মানবজাতির জন্য আল্লাহতাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। কোরান জ্ঞান ও ক্ষমার ফল্গুধারা। আল-কোরান শুধু মমিনদের সম্পদ নয়, বিশ্বমানবের সম্পদ।

৩০ পারা কোরানে সমগ্র মানবজাতির কল্যান নিহিত। মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহাগ্রন্থ আল কোরান মানবতার কান্ডারী। মহাগ্রন্থ আল কোরান আল্লাহর বানী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর ওপর নাজিলকৃত সর্বশ্রেষ্ট আসমানী কিতাব। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর বানীগুলি শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর সব মানুষের জন্য। মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির একমাত্র উপলক্ষ এই বিষয়টি মনে রেখেই তাঁকে মূল্যায়ন করতে হবে।

অন্যথায় হযরত মুহাম্মদ (সঃ)- এর অমূল্য জীবন ও আদর্শের অবমূল্যায়ন করা হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন হে নবী আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে সমগ্র বিশ্বের কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং যাকে উদ্দেশ্য করে এই পৃথিবী সৃষ্টি, তাঁকে ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও অলৌকিক ঘটনা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হওয়ার পক্ষে সন্দেহাতীতভাবে জলন্ত প্রমান বহন করে। বিনয় ও নম্রতা ছিল রাসুল (সঃ)-এর ভূষণ। আল্লাহর হুকুম এবং রাসুলের (সঃ) জীবন দর্শন মানলে সবখানে শান্তি।

উল্লেখ্য যে, বিশ্বনবী হযরত মুহ্মাদ (সঃ)-এর পূর্বে যে সকল নবী রাসুল এসেছিলেন, তা নিজ কওমের বা নির্দিষ্ট কোন বিশেষ অ লের লোকেদের হেদায়েত করার জন্য। তারা সবাই ছিলেন আ লিক ও জাতীয় নবী। কেউ বিশ্বনবী ছিলেন না। আর তাদের কারো উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব ছিল না। কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সঃ) সর্বশেষ নবী ও রাসুল হওয়ার কারণে তার উম্মতের উপর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

ইসলাম কোন জাতির জন্য নয়, কোন বর্নের জন্য নয়, কোন বিশেষ অ লের জন্য নয়, ইসলাম এসেছে বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য। বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী হিসেবে তাই তিনি বিশ্বনবী, সর্বশ্রেষ্ট নবী ও মহামানব। নবীপ্রেম ঈমানের অন্যতম শর্ত। মুহাম্মদ (সঃ)-এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা, চেতনা, কর্মদক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা ছিল আসাধারণ, অনন্যসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী।

মানবতার মুর্ত প্রতীক হযরত মহাম্মদ (সঃ) ছিলেন আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধন। মহানবী (সঃ)- এর সর্বপ্রথম কাজ ছিল দাওয়াত দেওয়া। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন পৃথিবীর অদ্বিতীয়, অপ্রতিদ্ব›দ্বী ও সর্বাপেক্ষা সফল রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতুলনীয় ও অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক। তিনি পারস্পরিক স¤প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আলোকে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ট রাসুল ও বিশ্বনবী মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। রাসুল (সঃ)- এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমান হলো মিরাজ এবং মিরাজ হলো রাসুলের একটি বিশেষ মোজেমা। বিশ্বনবী (সঃ)-কে আল্লাহ তাআলা শুধু দুই একটি ছোট খাটো মামুলি উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠান নি, বরং বিশ্ব মানবতার পরিপূর্ণ কল্যানের মহতী উদ্দেশ্যেই মহানবী (সঃ)-কে এই জগতে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বনবীকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠানো হয়েছে।

ইসলাম আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্তি¡কভাবে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ উপমা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সুমহান নৈতিক গুণাবলীর (মূল্যবোধ) পূর্ণতা সাধনের জন্য। উল্লেখ্য যে, মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মণীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমাণুসারে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)- কে সর্ব প্রথম সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিশ্বনবী (সঃ) জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মণীষী বলা হবে না বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মণীষী।

মহান আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃপায় আমরা পবিত্র রবিউল মাস অতিক্রম করছি। এই পবিত্র মাসেই বিশ্বনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)- কে পৃথিবীতে আল্লাহ পাক শান্তির অমিয় বানী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। এ মাসে আমাদের আরও বেশী বেশী মহানবী (সঃ)-এর জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা এবং এর বাস্তবায়নের চেষ্টা করা উচিত। তাঁর জীবনাদর্শ, চরিত্র ও জীবন দর্শন আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষনই আলোচনা করতঃ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাসুলুল্লাহর (সঃ) চরিত্র বলতে সমস্ত পাক কোরানকে বুঝায়। তার জীবন ছিলো জীবন্ত কোরান।

তাঁর চরিত্র ও আদর্শ আমরা জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না বলে আমাদের জীবনে শান্তি আসে না। আমাদের মনে এক, মুখে আর এক এবং কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই বলেই আমরা রসুলুল্লাহ (সঃ)- এর আদর্শ ও চরিত্র জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না। আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের আলোকে এবং রাসুল (সঃ)-এর রেখে যাওয়া মডেল অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রের পূনর্গঠনই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত। আসুন, বিশ্বনবীর সুমহান আদর্শ ও সুন্নত অনুসরণ করে হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করে বিশ্বভ্রাতৃত্য গড়ে তুলি, মানব কল্যাণে বিশ্ব শান্তি স্থাপন করি।

লেখক: আলহাজ্ব প্রফেসর মো.আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয় সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা। সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড। সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, ঢাকা।