এক নজরে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে যত ঘটনা

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার রায়ে অভিযুক্ত ৩২ জনের সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন ভারতের আদালত।

মামলার রায়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন বিচারক।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে গুড়িয়ে দেওয়া হয় ১৫ শতকের ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ। সেই ঘটনার দীর্ঘ ২৮ বছর পর বুধবার মামলার রায় ঘোষণা হল।

লখনউয়ের বিশেষ সিবিআই আদালতে রায় ঘোষণা করেন বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদব রায়।

এক নজরে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ

প্রতিষ্ঠা ১৫২৮ সালে:

রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত। তারই কাছে রামকোট পর্বত। ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ। আবার এও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ বলেও পরিচিত ছিল।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি:

বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বারবার। অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে।

সংঘাতের সূত্রপাত:

সংঘাতের সূত্রপাত হওয়ায় ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়।

হিন্দুদের দাবি:

আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি। তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি।

মূর্তি স্থাপন:

১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর– বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়।

নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ:

রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন “ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে।”

মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন।

দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে:

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ। অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন।

‘রাম রথযাত্রা’:

১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস’-এর অনুমতি পায়। ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা’ শুরু করেন।

১৯৯২ এর সেই ঘটনা:

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গণে পৌঁছান। ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়। ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

সমঝোতার উদ্যোগ:

২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন। বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শিলালিপি কী বলে:

পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল। আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী’-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির।

বিজেপি দোষী:

বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়:

২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত। এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন। রায়ে আরও বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক।

হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন:

হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে। দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনওপক্ষই জমিটি ভাগ করতে চায় না।

ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়:

ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’। গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন। অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল।

মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়:

ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির ওপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা। বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে।

অভিযুক্ত ৩২ জনের সবাই বেকসুর খালাস:

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় দায়ের মামলায় বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলিমনোহর জোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিংহ, সতীশ প্রধান এবং রামমন্দির ট্রাস্টের প্রধান নৃত্যগোপাল দাস-সহ মোট ৩২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের সবাইকে এই মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়।

সূত্র: আনন্দবাজার, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও ডয়েচে ভেলে