ঐতিহ্যবাহী চলনবিলের পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত, পানি শুকিয়ে নেমে আসছে বিপর্যয়!

মানুষের প্রয়োজনে উন্নয়নের ধাক্কায় উত্তরাঞ্চলের এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী প্রমত্ত চলনবিলের চলন থেমে গেছে। খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়ে এখন মরা বিলে পরিণত হয়েছে। চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালনকারী নদী খাল, জোলা, খাড়ি দখল, দুষণ আর অপরিকল্পিত সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ আর উন্নয়নের অগ্রযাত্রার প্রসব যন্ত্রণায় পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় এখন আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেও সমুদ্রসম চলনবিল পানিশূণ্য থাকছে। ফলে হারিয়ে গেছে চলনবিলের ঐতিহ্য সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ, পাখিসহ পরিবেশবান্ধব জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদ। জীববৈচিত্রের ঘটেছে অপমৃত্যু। চলনবিল অঞ্চলের নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। নদীর মাঝে আবাদ হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের। এতে করে ক্রমেই অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের মুখে পতিত হচ্ছে বলে সচেতন মহল মনে করছেন।

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অঞ্চল হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী চলনবিল। পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া ও বড়াইগ্রাম উপজেলাসহ ৮টি থানাব্যাপী চলনবিলের অবস্থান। বর্তমান চলনবিলের আয়তন প্রায় ৮০০ বর্গমাইল। এই চলনবিলে বর্ষাকালে বছরের পর বছর ধরে পদ্মা ও আত্রাই বিধৌত পলি জমে বিলের উত্তরাঞ্চল উন্নত হওয়ায় চলনবিল ক্রমে দক্ষিণে সড়ে পড়েছে। চলনবিলের জলরাশি বদ্ধ বিলের ন্যায় স্থীর না হয়ে নদীর স্রোতের ন্যায় চলন্ত বা গতিশীল ছিল বলেই এর নামকরণ করা হয় ‘চলনবিল’ অর্থাৎ চলন্ত বিল।
চলনবিলের বুকচিড়ে আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় অনেক নদ-নদী, জোলা, খাল, খাড়ি প্রবাহিত হচ্ছে। এইসব নদ-নদী জোলা খাল দিয়ে উজান থেকে বিপুল জলরাশি প্রবাহিত হয়ে চলনবিলের প্রাণ সঞ্চালণ করে আসছে। নদ-নদীগুলি হচ্ছে, বড়াল, গুমানী, চিকনাই, আত্রাই, নন্দকুঁজা, নারোদ নদ, মরা আত্রাই, বেশানী, ভাদাই (ভাষানী), করতোয়া, ফুলজোড়, তুলশী, চেঁচুয়া, বানগঙ্গা, গুড়, বারনই, মির্জামামুদ, গোহাল, বিলসূর্য, কুমারডাঙ্গা। চলনবিলের প্রাণদায়িনী এইসব গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী খাল, জোলার উপর অপরিকল্পিতভাবে সুইচগেট রাবারড্যাম্প, ব্রীজ, কালভার্ট, বাঁধ, পাকা সড়ক গুচ্ছগ্রাম, আদর্শগ্রাম, আশ্রায়ণ, আবাসনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ এবং প্রভাবশালী ভুমি খেকোদের অবৈধ দখলদারদের অপরিণামদর্শী নির্যাতনে ৮০ ভাগ নাব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে।

প্রমত্তা বড়াল, গুমানী, চিকনাই, তুলসিগঙ্গা, মির্জামামুদ, বোয়ালীয়াসহ অনেক নদী খাল ভূমিখেকোদের দাপটে নিজ অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। মৃত্যুর প্রহর গুনছে চলনবিলের জীবনদাত্রী বড়াল, আত্রাই, নন্দকুঁজা নারোদ আর গুমানী নদী। বর্ষা মওসুমে ২০ ভাগেরও কম পানি প্রবাহিত হয় মাত্র ৩ থেকে ৪ মাস। যার ফলে এখন আষাঢ় মাসেও চলনবিলে পানি থাকে না। চলনবিল অঞ্চলের নদ-নদীর মাঝে এখন আবাদ করা হচ্ছে নানা ফসলের। চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ চলছে জোরেসোরে।

চলনবিলের বুকের ওপর দিয়ে জাতীয় ও আন্ত: যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য সড়ক-মহাসড়ক,বাঁধ নির্মাণ করে চলমান চলনবিলকে বহু খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবহিকতায় নির্মাণ করা হয় চাঁচকৈড় খলিফাপাড়া থেকে আত্রাই মান্দা পর্যন্ত আত্রাই নদীর পাড় বরাবর দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, নাটোর-সিংড়া-বগুড়া মহাসড়ক, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক, বওসার হিজলতলা ঘাট থেকে তাড়াশ-বিনসারা নিমাইচড়া নামের বন্যনিয়ন্ত্রণ বাঁধ, তাড়াশ-বারুহাস সড়ক, তাড়াশ-সগুনা সড়ক, খুবজিপুর-বিলশা সড়ক এবং ছাইকোলা চাটমোহর বাঁধ চলনবিলকে খন্ড বিখন্ড করে চলনবিলের নিজ সত্বা ও অস্তিত্ব বিলীন করে ফেলেছে। চারঘাটে বড়ালের মুখে, আটঘরিয়া বড়াল ও নন্দকুঁজা নদীর ওপড় ৩টি সুইসগেট নির্মাণ করে নদী দুইটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নদীর প্রশস্ততা ৮০ ভাগ সঙ্কুচিত করে সুইসগেট ইসগেট তিনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বর্ষাকালেও পদ্মার পানি বড়ালে ঢোকেনা। পানির প্রবাহ না থাকায় প্রবাহমান চলনবিল এখন মরাবিলে পরিণত হচ্ছে।

চলনবিলের অতীত ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান জানান, চলনবিল রক্ষায় তাদের বেশ কয়েকটি দাবী রয়েছে। তারমধ্যে রয়েছে চলনবিলকে রক্ষা করতে হলে চারঘাটের বড়ালের মুখে এবং আটঘরিয়ার বড়াল এবং নন্দকুঁজা নদীর উপর নির্মিত অপ্রস্বস্ত সুইসগেট তিনটি অপসারণ করতে হবে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সীমানা খুঁটি স্থাপন করতে হবে। বড়াল, নন্দকুঁজা, আত্রাই, গুমানীসহ চলনবিলের বুকচিরে প্রবাহিত সকল নদ-নদী খাল- জোলা পূনঃখনন করে নব্যতা ফিরে এনে বাধাহীন পানির স্বভাবিক প্রবাহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বপরি চলনবিলে যাতে বাধাহীনভাবে পানি প্রবেশ করতে পারে সে বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে যাচাই করে সরকারী উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।