খাগড়াছড়িতে শিক্ষাবিদ অনন্ত বিহারী খীসার মহাপ্রয়াণে বিভিন্ন মহলের শোক

খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট প্রবীণ শিক্ষাবিদ অনন্ত বিহারী খীসা আর নেই।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৪৫মিনিটে খাগড়াছড়ি পৌর সদরের অনন্ত বিহারী মাস্টার পাড়ার নিজ বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪বছর। তিনি ৩ছেলে ও ১মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

তাঁর মৃত্যুতে পার্বত্য চট্টগ্রামে গভীর শূণ্যতা সৃষ্টি হলো।

তিনি ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার পিতা ছিলেন। তার এক ছেলে প্রসীত বিকাশ খীসা পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ’র প্রধান। শুক্রবার(২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০২১) দুপুর ২টায় অনন্ত বিহারী মাস্টার পাড়া মহাশ্মশানে তাঁর দাহক্রিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।

তাঁর মৃত্যুতে খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রুু চৌধুরী, মারমা উন্নয়ন সংসদের সভাপতি মংপ্রুু চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সভাপতি জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি রিপোটার্স ইউনিটি’র সভাপতি চাইথোয়াই মারমা, চাকমা একাডেমীর সভাপতি সন্তোষিত চাকমা বকুল, বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যান সংসদের বিবিসুৎ ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

অনন্ত বিহারী খীসা ১৯৩৭সালের ১লা নভেম্বর খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার খুলারাম পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরীতে যোগদান করেন এবং ১৯৯৫সালে অবসরে যান। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি জেলার রামগড় সরকরি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অবসরকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি খাগড়াছড়ির খবংপুড়িয়া স্কুলে নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা(শিশু শ্রেণী, প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণী), খাগড়াছড়ি এম,ই স্কুলে তৃতীয় থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় হতে ৭ম শ্রেণী থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায়(বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষার তৎকালীন নাম) উত্তীর্ণ হন। তারপর ঢাকার জগন্নাথ কলেজে দু’বছর পড়ার পর চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে বি,এ পাশ করার পর ছাত্রজীবনের ইতি টানেন।

অনন্ত বিহারী খীসা ছাত্র জীবনে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬সালে তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার শ্রীপুর গ্রামে এক ছাত্র-অভিভাবক সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি সভাপতি ও মৃণাল কান্তি চাকমা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থেকে গেছেন। পরে তিনি শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে আমৃত্যু তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সমাজসেবামূলক নানা কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা-চর্চা ও চিন্তার বাতিঘর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ শ্রদ্ধেয় অনন্ত বিহারী খীসার মহাপ্রয়াণে গভীর শোক ও দু:খ প্রকাশ করেছেন খাগড়াছড়ি ২৯৮নং আসনে সাংসদ টাস্কফোর্স’র চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রী পদমর্যদা কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগ পেইজের এক বার্তায় তিনি বলেন, খাগড়াছড়ি তথা তিন পার্বত্য জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, সমাজ ও সুধীজনদের প্রিয়মুখ অনন্ত বিহারী খীসা (এবি খীসা) প্রকাশ অনন্ত স্যার বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা নাগাদ খাগড়াছড়ি জেলা শহরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমি খাগড়াছড়ির সকল মানুষ এবং আমার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমরা বিশ্বাস করি, ‘অনন্ত স্যারের মতো বিদগ্ধ সমাজচিন্তক এবং সমাজ সংস্কারক, এ সময়ে বড়ো বিরল। দেশ-জাতির সংকট-সম্ভাবনায় এবি খীসা একজন অনুপম ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। পৃথিবীর দেশে দেশে তাঁর অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী বহুমাত্রিক প্রতিভায় নিবেদিত। ’আমরা, তাঁর বিদেহী আত্মার পরম শান্তি কামনা করছি।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রুু চৌধুরী শোক প্রকাশ করেছেন। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ জনসংযোগ কর্মকর্তা চিংলামং চৌধুরীর পাঠানো এক বার্তায় তিনি বলেন, শ্রদ্ধেয় অনন্ত বিহারী খীসার প্রয়াণে আমরা একজন আলোকিত মানুষকে হারিয়েছি আমাদের এ শূণ্যতা পূরণ হবার নয়। শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি অনন্ত বিহারী খীসার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ) এর সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা, ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের সভাপতি সচিব চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি অংগ্য মারমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভানেত্রী নিরূপা চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি বিপুল চাকমার পাঠানো একবার্তায় বলা হয়-শিক্ষা, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি পাহাড়ি-বাঙালি সবার স্মৃতিতে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বেঁচে থাকবেন বলে তারা মন্তব্য করেন এবং তার মৃত্যুতে জনগণ একজন বড় অভিভাবককে হারিয়েছে। এক যুক্ত বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক ও ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসার পিতা অনন্ত বিহারী খীসার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা বিস্তারে তার বিশাল অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, অনন্ত বিহারী খীসা ছিলেন একজন অত্যন্ত সৎ, নীতিবান, প্রজ্ঞাবান, একনিষ্ঠ ও আদর্শ শিক্ষক। তার জীবনাচার ও কর্ম অনেকের কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।

তাকে একজন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন গুণী ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা বলেন, ‘অনন্ত বিহারী খীসা ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং জেল খেটেছিলে। বিশেষ করে ১৯৫০দশকের শেধার্ধে পাহাড়ি ছাত্রদের সংগঠিত করতে ও জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’

এছাড়া পরবর্তী জীবনে শিক্ষা পেশায় জড়িত থাকার সময়ও তিনি বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠানে ভূমিকা রেখেছিলেন বলে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেন।
তারা অনন্ত বিহারী খীসাকে একজন বড় মাপের ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি বিভিন্ন সময় পাহাড়ি জনগণের উপর শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিতদের নানাভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন।

শিক্ষা, সমাজ ও জাতীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি পাহাড়ি-বাঙালি সবার স্মৃতিতে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে বেঁচে থাকবেন বলে তারা মন্তব্য করেন এবং বলেন তার মৃত্যুতে জনগণ একজন বড় অভিভাবককে হারিয়েছে।

উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি পৌর সদরের অনন্ত মাষ্টার পাড়ার নিজ বাড়িতে বৃহস্পতিবার দুপুরে অনন্ত বিহারী খীসা বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।