চটকদার অফারের খপ্পরে পড়ে এখন আতঙ্কে ই-কমার্স গ্রাহকরা

চটকদার অফারের খপ্পরে পড়ে অনেকেই ই-কমার্স সাইটগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন পণ্য কেনার জন্য। কেউ দু-একবার পণ্য কিনে সফল হওয়ায় পরবর্তীতে লোভে পড়ে নিজে এবং পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকেও পণ্য কিনতে উৎসাহ দেন।

কিন্তু সেসব পণ্যের অর্ডার নির্দিষ্ট সময়ে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তারা। তবু আশায় ছিলেন দেরিতে হলেও হয়তো তাদের অর্ডারকৃত পণ্য ফেরত পাবেন।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় অনেকের বিরুদ্ধে মামলা এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে গেছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। ফলে পণ্য কিনতে জমা দেওয়া গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আটকে আছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আর সেই টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছেন তারা।

ই-অরেঞ্জের এক ক্রেতা আবু হক (ছদ্মনাম) জানান, গত বছরের এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে অনলাইনে কেনাকাটা শুরু করেন।

এরপর ৫০% ছাড়ের ঘোষণায় সেখান থেকে একটি মোটরসাইকেল কেনেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পণ্য হাতে পান। তার মতো আরো অনেকেই এভাবে বিশেষ ছাড়ের পণ্য কিনে সময়মতো পণ্য হাতে পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি তাদের আস্থা বেড়ে যায়। এর ফলে তিনি তার পরিবারের অন্য সদস্যদের পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবকেও ই-অরেঞ্জ থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহ দেন।

চলতি বছরের জুনে তার পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবরা প্রায় মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার জন্য ২২ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান করেন। কিন্তু নির্দিষ্ট অতিবাহিত হলেও সেসব পণ্য সরবরাহ করেনি ই-অরেঞ্জ।

এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেপ্তারের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ই-অরেঞ্জের কার্যক্রম। এ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটছে আবু হকের।

তিনি বলেন, ‘আমরা কোথায় যাব কার কাছে যাবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভোক্তা অধিকারের কাছে গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। আমাদের পরিবারের সদস্যদের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ এবং আমার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বন্ধুরা প্রায় ১০-১১ লাখ টাকার পণ্য কিনেছে। নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে।’

আবু হকের মতো এমন অসংখ্য গ্রাহক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে পণ্য কিনতে গিয়ে অগ্রিম অর্থ প্রদান করায় বিপাকে পড়েছেন।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, গ্রাহকদের অর্থ তারা এক সময় ফেরত পাবেন।

গত জুনে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় ক্রেতার স্বার্থ রক্ষায় লেনদেন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়।

সিদ্ধান্ত হয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতার আগাম পরিশোধ করা টাকা সরাসরি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হবে না। ক্রেতারা অর্ডারের বিপরীতে আগাম যে টাকা পরিশোধ করবে, তা থাকবে তৃতীয় পক্ষের কাছে। এই তৃতীয় পক্ষ হলো অনলাইনে লেনদেনের অর্থ সংগ্রহকারী ‘পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (পিএসও)’।

এই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা পরিশোধ করা টাকা জমা থাকবে। ক্রেতা পণ্য হাতে বুঝে পেলেই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেবে পিএসও প্রতিষ্ঠান।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান জানান, গ্রাহক পণ্য বুঝে পাওয়ার পর ডেলিভারি মেসেজ দিলে বিক্রেতা মূল্য পাবেন। আর এ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গেটওয়ের মাধ্যমে এই অর্থ লেনদেন হচ্ছে।

তবে তার পরামর্শ, গ্রাহকরা যেন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড, বিকাশ বা নগদের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে কেনাকাটা করেন। তারা যেন আগাম নগদ অর্থ পরিশোধ না করেন।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা, মানি লন্ডারিং এবং অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠায় অভিযোগ তদন্ত করছে সরকার।

ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকুম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিড ডট কম ডট বিডি এবং আলেশা মার্টসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ডাবল ভাউচার, সিগনেচার কার্ড ও বিগ বিলিয়ন রিটার্নসহ নানারকম চটকদার অফারে অস্বাভাবিক মূল্যছাড়ের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার প্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টার মামলার পাশাপাশি সাইবার অপরাধ হিসেবে ই-কমার্স সাইটে নজরদারি শুরু করেছে। ধামাকা শপিং ডটকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলেও তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

সর্বশেষ ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গতকাল ১৭ আগস্ট এক হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণার মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক গ্রাহক।

সাইবার তদন্তকারীরা বলছেন, অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকটি ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের গ্রেপ্তারের পর ই-কমার্সের প্রতারণা সামনে আসতে থাকে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও শত শত গ্রাহক অভিযোগ করছেন। এ কারণে নজরদারির আওতায় নেওয়া হয়েছে ১৪টি প্রতিষ্ঠান।

এগুলো হলো ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা শপিং ডটকম, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, আলেশা মার্ট, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস।

এদিকে নয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক লেনদেন এবং আর্থিক তথ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল থেকে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়।

যেসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ধামাকা, ই অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকুম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিড ডট কম ডট বিডি এবং আলেশা মার্ট।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘এই ৯ ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে মার্চেন্টদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে মূল্য পরিশোধ না করারও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা, ক্রেতা ও মার্চেন্টদের কাছে মোট দায়ের পরিমাণ জানা দরকার।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি ও স্থায়ী মূলধনের পরিমাণও জানা দরকার। আরো জানা দরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো অর্থ কোথাও সরিয়েছে কি না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুন মাসে ইভ্যালির ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে উঠে আসে, গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনা ৪০৩ কোটি টাকা আর কোম্পানিটির চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি টাকা।

এদিকে অগ্রিম টাকা নিয়েও পণ্য বা অর্থ ফেরত না দেওয়ায় ই-অরেঞ্জের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা হয়েছে। তাহেরুল ইসলাম নামের এক গ্রাহক গুলশান থানায় এ মামলা করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন।