চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভোটে অনড় নৌকার ১২ ‘বিদ্রোহী’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ভোটে অনড় নৌকার ১২ ‘বিদ্রোহী’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সক্রিয় থাকলেই বহিস্কারসহ কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে— দল থেকে সোজাসাপ্টা এমন কঠোর কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দেওয়া হলেও বিদ্রোহী প্রার্থীরা বলছেন যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে থাকবেন তারা। তাছাড়া এই মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোরও সুযোগ নেই— এমন মন্তব্য করে এসব প্রার্থী উল্টো প্রশ্ন তুলছেন কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়ার যৌক্তিকতা ও প্রক্রিয়া নিয়ে।

কোনো নিয়মনীতি না মেনে ব্যক্তি স্বার্থে ‘ষড়যন্ত্রের’ মাধ্যমে চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে— এমন অভিযোগ তুলে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে চিঠিও দিচ্ছেন এসব নেতারা। ‘দলের দুঃসময়ের কর্মী’ দাবি করে এসব প্রার্থীরা বলছেন, ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে দলের সুসময়ে তাদের বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র চলছে।

গত ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণের কথা ছিল। পরে করোনার কারণে ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত করা হয়। সবশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্থগিত হওয়া নির্বাচন

এবারের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে সবগুলো দল। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের ১২ জন বর্তমান কাউন্সিলর এই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
শুরু থেকেই তাদের ব্যাপারে দল কঠোর অবস্থানের কথা বলে আসলেও করোনাকালে তাদের নিয়েই বিভিন্ন দলীয় ও সামাজিক কর্মসূচি পালন করে মহানগর আওয়ামী লীগ। সে সময় অনেকটাই মাঠ গুছিয়ে নেন দলের ভাষায় ‘বিদ্রোহী’ এসব প্রার্থী।

তবে নতুন করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে আবারও এসব প্রার্থীর ব্যাপারে আগের অবস্থানে ফিরে যায় আওয়ামী লীগ। শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। না হলে তাদের ব্যাপারে কঠিন সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি যেসব নেতাকর্মী তাদের পক্ষে কাজ করবে, তাদেরও বহিস্কার করা হবে।
কাউন্সিলর পদে দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে যারা নির্বাচন করছেন, তারা হলেন— ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম জসীম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডের এফ কবির মানিক, ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের এসএম এরশাদ উল্লাহ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের এইচএম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের আব্দুল কাদের, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গীবাজার ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ বিপ্লব ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মাজাহারুল ইসলাম চৌধুরী।

এরা সকলেই চসিকের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
চট্টগ্রামে এসে মাহবুবুল আলম হানিফের দেওয়া কড়া হুঁশিয়ারির পর নির্বাচন নিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের অবস্থান জানতে কমপক্ষে আটজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সাথে আলাপ হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের। তারা সকলেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।

৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম জসীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমাদের ভাবনা হলো যে আমরা নির্বাচন করবো— এটাই মূল কথা। নির্বাচন করার জন্য এলাকার ভোটারদের প্রচণ্ড চাপ আছে। তারাই চাইছে আমরা যাতে নির্বাচন করি। কারণ গত পাঁচ বছর আমরা তাদের সুখে-দুঃখে ছিলাম। করোনাকালেও আমরা মানুষের ঘরে ঘরে গেছি। ’

কেন্দ্রীয় নেতাদের কঠোর অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে জসিম বলেন, ‘উনারা উনাদেরটা বলছেন। আজকেও আমরা কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ ভাইয়ের সাথে দেখা করছি। আমরা উনাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি যাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাদের যাচাই বাছাই করে দেওয়া হয় নাই। যেমন আমার এলাকায় যাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে সে এক সময় বঙ্গবন্ধুর ছবি কুকুরের গলায় ঝুলিয়েছে। উনার ৭৪ বছর বয়স, সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে সক্রিয় নন তিনি। হানিফ ভাই আমাদের কথা শুনেছেন। তিনি বলেছেন এসব তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের ভাইকে জানাবেন। ’

নিজেদের দলের দুঃসময়ের কর্মী দাবি করে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের মোরশেদ আক্তার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা পার্টির দুঃসময়ে জেল জুলুমের শিকার হয়েছি, আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। আমরা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কর্মী, নিজেদের আমরা নেতা বলি না। এখন দলের সুসময়ে আমাদের বঞ্চিত করবে— এরা কারা?’

মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে মহানগর আওয়ামী লীগের এই সদস্য বলেন, ‘দলের সমর্থন আমরা পাইনি। কিন্তু আমাদের জনসমর্থন আছে। মহানগর আওয়ামী লীগের মতামত কিংবা তৃণমূলের মতামত নিয়ে কি কাউন্সিলর পদে দলের সমর্থন দেওয়া হয়েছে? কারা এদের তালিকা করলো? কাদের স্লিপে এসব মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে? তাছাড়া দলীয় প্রতীক তো নৌকা। আমরা তো নৌকাকে বিজয়ী করতে সর্বস্ব বাজি ধরা কর্মী। নৌকার বিরুদ্ধে তো আমরা নই। ’

নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ নেই— এমন মন্তব্য করে মোরশেদ বলেন, ‘আমরা আগেও মানুষের পাশে ছিলাম মহামারীতে জনগণের পাশে ছিলাম। এমনকি করোনা আক্রান্ত রোগীকে আমি নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। এখন মানুষ আমাদের আরও বেশি করে চায়। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোন উপায় তো আমি দেখছি না। ’

৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডের হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘করোনাকালে দলের সব কর্মসূচিতে আমরা ছিলাম। এর আগেও যখন নমিনেশন সাবমিট করেছি, এরপর এত সময় গেল দল তো তখন আমাদের কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি। করোনার সময়ে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এসব করতে গিয়ে আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। আমি তো মারাও যেতে পারতাম। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, মানসিকভাবেও অপদস্থ হয়েছি। পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ তো আমাদের নাই। ’