ছাত্রলীগ: আওয়ামী লীগের বোঝা না সম্পদ?

আইন অনযুযায়ী এখন আর কোনো ছাত্র সংগঠন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করতে পারে না, অঙ্গ সংগঠন হতে পারে না। কাগজে-কলমে না পারলেও বাংলাদেশের সকল ছাত্র সংগঠন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করে। ছাত্রলীগ যেমন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। সাধারণত মূল দল গঠনের পর গঠিত হয় সমমনা ছাত্র সংগঠন। তবে ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। ছাত্রলীগ গঠিত হয়েছে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, আর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরের বছরের ২৩ জুন। তবে দুটি সংগঠনের গঠন প্রক্রিয়ায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায় দেড় বছর পর গঠিত হলেও আওয়ামী লীগ বরাবরই ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করে আসছে।

এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো সংগঠনের একটি ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৬২এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ৯০এর গণআন্দোলনের ছাত্রলীগের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের অন্যতম লক্ষ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), যেটা তখন ছাত্রলীগের আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্কটের সময়েও দারুণ সাহস নিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল ছাত্রলীগ।ছাত্রলীগের নেতারা পরে মূল দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। ছাত্রলীগ হলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তৈরির প্লাটফর্ম, নেতৃত্ব সরবরাহের পাইপলাইন। আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে আওয়ামী লীগের মূল স্ট্রাইক ফোর্স ছাত্রলীগ। ৭৫এর পর যে ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল, ছাত্রলীগ তাদের পাশে পাশেই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই যেন দিশা হারায় ছাত্রলীগ।

বিশেষ করে ২০০৮ সালে এই দফায় ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ যেন তাদের সকল অর্জন মুছে দেয়ার লড়াইয়ে নামে। একের পর এক অপকর্মে ম্লান হয়ে যায় উজ্জ্বল অতীত।গত ৯ বছরে হেন অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগ করেনি। ‘ছাত্রলীগ’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে যা আসে, তার কোনোটাই ভালো কিছু নয়। বিশ^জিত হত্যা বা সিলেটের বদরুলের নৃশংসতার কথা তো সবারই জানা। হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসির লাঠিয়াল- অপকর্মের ফিরিস্তি বহুত লম্বা।আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের পাশে থাকা যত সহজ, দল ক্ষমতায় এলে নিজেদের ঠিক রাখা ততটাই কঠিন। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা কী হবে, এটা আসলে ছাত্রলীগ ঠিক করতে পারেনি। তাই তো ছাত্রলীগের ভূমিকা এখন লাঠিয়ালের, দখলদারের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হল এখন ছাত্রলীগের দখলে। তারপরও ডাকসুসহ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না বছরের পর বছর। কেন হয় না? আমার ধারণা অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখলে থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে অধিকাংশ ছাত্র সংসদেই হারবে ছাত্রলীগ। কারণ হল দখল করা যত সহজ, শিক্ষার্থীদের হৃদয় দখল করা ততটাই কঠিন। ছাত্রলীগ কঠিন কাজটা করার চেষ্টাও করেনি, সহজ কাজটা করছে দাপটের সাথে।

ছাত্রলীগ এখন যেন লাঠিয়াল। স্থানীয় নেতা ও এমপিদের যত অপকর্ম, দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবজি সব করার দায়িত্ব যেন ছাত্রলীগের। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিপদে পড়লেও পুলিশ না ডেকে ছাত্রলীগকে ডাকেন। আর এভাবে বারবার অপব্যবহারে ছাত্রলীগ নিজেদের সবকিছুর উর্ধ্বে ভাবতে শুরু করে। তাই বারবার নেতিবাচক কারণে সংবাদ শিরোনাম হয় ছাত্রলীগ। এটা ঠিক সারাদেশের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটিভূক্ত ছাত্রলীগের নেতাই আছে কয়েক হাজার। তাদের সবাইকে নজরদারির মধ্যে রাখা সত্যি কঠিন।

ইউনিয়ন পর্যায়ের কোনো নেতা কোনো অপকর্ম করলেও তার দায় চাপে ছাত্রলীগের ঘাড়ে। এটা হতেই পারে। কিন্তু আসল কথা হলো, অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কোনো খবর এলেই ছাত্রলীগের প্রথম প্রতিক্রিয়া অস্বীকার করা। তাতেও পার না পেলে নামকাওয়াস্তে বহিস্কার। মিডিয়ার হইচই থেমে গেলে সেই বহিস্কৃতরা আবার মিশে যান ঝাকে। সমস্যাটা এখানেই। অপরাধীরা আইনানুগ শাস্তি পেলে ছাত্রলীগের দায় কিছুটা কমতো, যদি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জানে অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না; তাহলেই শুধু তারা সতর্ক থাকবে।

ছাত্রলীগের এই অপকর্মের খবর যে মূল দলের নেতারা জানেন না বা রাখেন না; তা নয়। বিরক্ত হয়ে শেখ হাসিনাও একবার ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমার বিবেচনায় ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় সমালোচকের নাম ওবায়দুল কাদের। সবাই মুখে বলেন, কিন্তু ছাত্রলীগকে পরিচ্ছন্ন করার কার্যকর উদ্যোগ নেন না। ছাত্রলীগকে পরিচ্ছন্ন রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো পরিচ্ছন্ন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আনা।

এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখন ছাত্রলীগের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হলো অনুপ্রবেশ। সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার সময় বলেছিলেন, ছাত্রলীগে শিবির ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ঢুকে পড়া সেই শিবিরকে বের করার কোনো চেষ্টা করেননি কেউ। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ছাত্রলীগের দুঃসময়ের সৈনিকদের একজন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম অনুপ্রবেশ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজকাল একটি কথা প্রায়ই শুনছি, তা হল ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারীর সমাগম ঘটেছে। অবাক লাগছে তাই না? আমি অবাক হই না।

সর্বক্ষেত্রে দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে। কোথায় নাই তারা? আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সংসদ, মন্ত্রিসভা কোথায় নাই অনুপ্রবেশকারী। ৭৫ এর পর থেকে যাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে পরিণত হয়েছি তাদের অনেককেই দলে, সংসদে এবং সরকারে গুরুত্বপুর্ণ অবস্থানে দেখে দেখে নিজেকেই এখন অনুপ্রবেশকারী মনে হয়। কম বয়সে ছাত্রলীগে ঢুকে পড়ে বলে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা কঠিন। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা অনুপ্রবেশকারী তারা প্রখ্যাত এবং কুখ্যাত, পরিচিত এবং চিহ্নিত। তবুও দোষ শুধু ছাত্রলীগের। তারপরও আশা করব ছাত্রলীগ নির্ভেজাল থাকবে। কারণ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু, আর সাংগঠনিক নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।’ আলাউদ্দিন নাসিমের যখন নিজেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী মনে হয়, তখন অনুপ্রবেশের ইস্যুটি আরো গভীরভাবে ভাবা, বিবেচনা করা এবং পরিচ্ছন্ন করা দরকার। ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশের জন্য সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদেও সুপারিশকে দায়ী করেছেন সংগঠনের বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন।

সাম্প্রতিক আরেকটি ইস্যু আলোচিত হচ্ছে- সিন্ডিকেট। এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই ফিসফাস হচ্ছিল। কিন্তু ওবায়দুল কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনে গিয়ে বলে এসেছেন সিন্ডিকেট আর চলবে না, পকেট কমিটিও হবে না। তার মানে এতদিন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব এসেছে কারো পকেট থেকে বা সিন্ডিকেট থেকে। তবে মনে হচ্ছে, এবার কমিটি আসবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে। ২০০৬ সালের পর থেকে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়ে আসছে। সর্বোচ্চ বয়সসীমা, নিয়মিত ছাত্রত্ব ইত্যাদিও অনুসরণ করা হয়েছে কঠোরভাবে। তাই নিয়মিত ছাত্ররাই এখন নেতৃত্ব দেন। কিন্তু নিয়মিত ছাত্র হলেও সে কতটা ছাত্রলীগ তা নিয়েই ফিসফাস। ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন- শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে তা সংগঠনের জন্য কার্যকর ফল বয়ে আনে না। কৌশলগত ও বানানো জনপ্রিয়তার কাছে বাদ পড়ে যায় যোগ্য, দক্ষ ও ত্যাগী নেতারা।

এবার তাই ভোট হচ্ছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার কথায় তারই ইঙ্গিত, ‘ভোটের আবার কিছু ভালোও আছে, মন্দও আছে। আমরা চাই উপযুক্ত নেতৃত্ব এবং ছাত্র। যদি দেখা যায় ভোটের মাধ্যমে উল্টাপাল্টা আসে, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।’ এখন পর্যন্ত সভাপতি পদের জন্য ১১১ জন এবং সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য ২১২ জন মনোনয়নপত্র কিনেছেন। তবে শীর্ষ নেতৃত্ব বেছে নিতে নানা পর্যায় থেকে তালিকা সংক্ষিপ্ত করে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।শুধু ব্যক্তি নয়, প্রার্থীর ব্যক্তিগত আদর্শ, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনা করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে, সিন্ডিকেট ভাঙতে এবার অনেক সতর্ক আওয়ামী লীগ। কারণ আওয়ামী লীগের বিবেচনায় নির্বাচনের বছরে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বোঝা হয়ে ওঠা ছাত্রলীগ যেন আবার রাজনীতির সম্পদ হয়ে উঠতে পারে, সে চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে সংগঠনের ২৯তম সম্মেলনকে সামনে রেখে। দেখা যাক চেষ্টা সফল হয় কিনা। নাকি লাঠিয়াল লাঠিয়ালই থেকে যায়।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।